“স্মৃতিমণ্ডিত রক্তক্ষরা অমর অকুশে ফেব্রুয়ারি আবার এলো রক্তাপ্লুত বাংলার মুক্তির আলোকে স্নাত সূর্য সন্তানদের মৈত্রীর মিছিলে। ভাষা জননীর কণ্ঠরোধ করার অপপ্রয়াস উৎপাটনের দুর্জয় শপথে উৎসর্জক মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণগুলো আমাদের অনুভূতিতে চিরভাস্বর।
সেদিন আরও রক্তের নিস্বরণে বাংলার শ্যামল প্রাণের রক্তধারায় যে জাতীয় পতাকার প্রতিচ্ছবি বিম্বিত হয়েছিলো, সে নিমন্ত্রণের দ্বিধাহীন সাড়ায় তারই উত্তরসুরীদের রক্তবন্যায় ভেসে আসা পতাকা আজ বাংলার বুকে উড্ডীন। বিগত পরিসরে পলাশ রাঙ্গা ফাগুনের স্মৃতিবহ গৌরবময় দিনটিকে আমরা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বরণ করেছি। কিন্তু আজ আমাদের আত্নোপলদ্ধি ও আত্মচেতনা উন্মেষের প্রকৃত সময়। তাই স্বাধীন প্রাণচাঞ্চল্যে আজকের একুশের অশেষ আহ্বানে সাড়া দিয়ে শহীদের অগ্নিমন্ত্রে প্রবুদ্ধ হয়ে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাবার বজ্র শপথ নিচ্ছি।”
উপর্যুক্ত কথাগুলো একটি সংকলনের সম্পাদকীয়। সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারিতে, আগুন ঝরা ফাগুন দিনে সদ্য রক্তস্নাত স্বদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রথম একুশের সংকলনের সম্পাদকীয়। সংকলনটির শিরোনাম ‘শেষ থেকে শুরু’। সংকলনটির সম্পাদনা করেন সেই সময় স্নাতক এর শিক্ষার্থী, এখনকার প্রবীন নাট্যকার সুদীপ কান্তি দেওয়ানজী। গত বছর তিনি এক সংবাদ মাধ্যমে বলেন, “১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে আত্মদানকারী শহীদদের আত্মত্যাগে প্রাণীত হয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের যাত্রা শুরু। লাখো শহীদের রক্তে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর এলো বহুল প্রতীক্ষিত সেই স্বাধীনতা। বায়ান্নো আর একাত্তরের শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের যাত্রা শুরুর সময় ছিলো বাহাত্তর। সেজন্য প্রয়োজন ছিলো আত্নোপলদ্ধি ও আত্মচেতনা উন্মেষের। তাই একুশের চেতনায় আত্ম অনুসন্ধানের একটি প্রয়াস ছিল আমাদের সংকলন।”
যুদ্ধ শেষ, নতুন দেশ গড়া শুরু; সেই চেতনা ধারণ করে সংকলনটির নাম রাখা হয়েছিলো “শেষ থেকে শুরু”। চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক কমলেশ দাশগুপ্ত বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত এটি সম্ভবত প্রথম একুশের সংকলন”।
“শেষ থেকে শুরু’ শুরু হয়েছে একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এর রচয়িতা মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী রচিত ‘একুশের গান’ কবিতাটির মাধ্যমে। একুশের গান-সহ আটটি কবিতা ও তিনটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে সংকলনটিতে। কবিতাগুলো হচ্ছে অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক রচিত একুশ ও তারপর, ইউসুফ পাশা রচিত রক্তে আমার মা, প্রদীপ কান্তি দেওয়ানজী রচিত হারিয়ে যেতে চাই, সৌমেন কান্তি দে রচিত সাক্ষী দিনটি, শফিকুল মান্নান রচিত অম্লান সেদিন, সুভাষ দত্ত রচিত অনন্ত দিনের ধ্বনি, সুদীপ কান্তি দেওয়ানজী রচিত এখনো কেন। প্রবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক তপন চক্রবর্তী, অঞ্জন কান্তি দাশ এবং অমর বিন্দু চৌধুরী। প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম যথাক্রমে আরো কয়েক পা, ভাষা প্রসঙ্গে ও চেতনার প্রশ্নে।
এছাড়া সূচিপত্রের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে এবং কয়েকটি রচনা শেষে খালি স্থানে কাজী নজরুল ইসলাম, জহির রায়হান ও শহীদুল্লা কয়সারের কবিতা থেকে অংশবিশেষ ছাপা হয়েছে। একুশ পৃষ্ঠায় গিয়ে ‘শেষ থেকে শুরু’ শেষ হয়েছে। পরের দুই পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন।
‘শেষ থেকে শুরু’ সম্পাদনা করেছেন সুদীপ কান্তি দেওয়ানজী, সহ-সম্পাদক অঞ্জন কান্তি দাশ, প্রধান সহযোগী সুভাষ দত্ত, প্রকাশক দীপক দাশ, মুদ্রণে দি ইস্টার্ন প্রেস-নন্দনকানন। প্রকাশনা সংস্থা আমরা কজন, দেওয়ান বাজার, চাটগাঁ। শুভেচ্ছা মূল্য তিনটি দশ পয়সা।
এছাড়া সহযোগিতায় চৌদ্দ জনের এবং পৃষ্ঠপোষকতায় চৌদ্দজনের নাম মুদ্রিত আছে। কিন্তু এই নিবন্ধকারের কাছে থাকা কপিটিতে কয়েকটি নাম ঝাপসা থাকায় কারো নাম দেয়া থেকে বিরত থাকা হলো।
সদ্য স্বাদীন বাংলাদেশের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরো ‘শেষ থেকে শুরু’ এর কর্মীবাহিনী সংকলনটি হাতে নিয়ে ছুটে যান শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানাতে আসা উপস্থিত জনতা বাড়তি পাওনা হিসেবে করপুটে গ্রহণ করেন ‘শেষ থেকে শুরু’। সংকলনটির তরুন কর্মীবাহিনীর একজন এখনকার প্রবীন নাট্যকার ও সাংবাদিক প্রদীপ দেওয়ানজী বলেন, “সদ্য স্বাধীন দেশে একুশের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও নতুন যাত্রায় বায়ান্নর চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদে এই সংকলন প্রকাশ করেছিলাম।”
সংকলনটি শুরু হওয়া মাহবুবু-উল-আলম চৌধুরীর ‘একুশের গান’ কবিতার প্রথম তিনটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে শেষ করছি-
“একুশের শহীদেরা চলে গেছে রক্তবীজ বুনে
বিশটি বছর ধরে আমরা ঢেলেছি তাতে যন্ত্রণার জল
এখন ভরেছে মাঠ আদিগন্ত চারিদিকে সোনার ফসল।”