স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়

আজ ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তী

প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | শুক্রবার , ২৬ মার্চ, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে বললেন ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’। একটি পরাধীন জাতির কাছে স্বাধীনতা পরম প্রত্যাশা। বাঙালি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। বাঙালির স্বাধীনতার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদ ও দু লক্ষেরও অধিক মা-বোন সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছিল। ১৬ই ডিসেম্বরে আসে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তী। আর বাঙাালি উদযাপন করছে জাতির পিতার জন্মজয়ন্তী, জন্মশতবর্ষ ও মুজিববর্ষ। বাঙালির মহাকাব্যিক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তির মাহেন্দ্রক্ষণে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বাঙালির স্বাধীনতা শুধু একটি পতাকা, সার্বভৌমত্ব বা মানচিত্র পাওয়া নয়। এতে বাঙালি পেয়েছে হাজারো বছরের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। বাঙালির বাংলাদেশ। এতে উন্মুক্ত হলো বাঙালির মুক্তির পথ। সুযোগ আসলো বহু আরাদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার। বিশ্বকবির ‘সোনার বাংলা’ বা নজরুলের ‘বাংলাদেশ’ বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর অনেক উপাধির একটি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ইতিহাস বলে বাঙালির অন্তত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। এ দেশ ও জাতি গঠনে, শাসনে, বিদ্রোহে, বিপ্লবে বা আত্মত্যাগে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছেন। অন্যদিকে বহু খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রেনেসাঁ পুরুষ অবদান রেখেছেন। আমরা জানি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের আগে অঞ্চল, দেশ, রাজ্য প্রদেশ এমনকি শাসনপ্রণালী, ধর্মপ্রচার ও সংস্কৃতিচর্চা সহজভাবে পরিচালিত হতো। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূতিতে ছিল জীবনবোধ। কিছু কিছু প্রবাদ প্রবচনে সেটি প্রতীয়মান হয়, ‘যেমন আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। হিন্দু-মুসলিম শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- ‘যতদিন আমাদের ধর্মবোধ সহজ ছিল, ততদিন গোঁড়ামি থাকা সত্ত্বেও কোন হাঙ্গামা বাঁধেনি’[সূত্র: কালান্তর ১১]। ব্রিটিশ শাসনের ফলে সেই সহজ সরল জীবন প্রণালী থেকে ভারতীয়রা উন্নত জীবন ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্রিটিশ মিশনারির উদ্যোগে শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রিয়াশীল ছিল। এমনকি অতীতের ব্রিটিশবিরোধী সকল প্রতিরোধ-সংগ্রাম, বাংলা-ভারতের জাতীয়তাবাদের দ্বার উন্মুক্ত করে। এ দেশে ব্রিটিশরা আসার পূর্ব পর্যন্ত জনসাধারণের চিন্তার দিগন্ত, সুখ ও সমৃদ্ধি আপন সীমায় আবদ্ধ ছিল। চিন্তা ও চিত্তের প্রসার যথাযথ হয়নি। বিশ্বকবির ভাষায় ‘ইংরেজ আমাদের জ্ঞান, চিন্তা, সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতির সকল ক্ষেত্রে নবযুগ নিয়ে আসে’ [সূত্র: কালান্তর-৮]। পলাশী (১৭৫৭) ও বঙার (১৭৬৪) যুদ্ধে জয়লাভ করে ব্রিটিশরা বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ভূমি ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার বাংলার সমাজ কাঠামোতে পরিবর্তন হতে থাকে। অন্যদিকে কিছু রেনেসাঁ মানব- ধর্ম, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে উদ্যোগ বাঙালির চিন্তার পরিধিকে কিছুটা বিস্তৃত করে। এক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও বিদ্যাসাগরদের অবদান উল্লেখ করার মতো। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও আঞ্জুমান গড়ে উঠতে দেখা যায়। এমনকি কিছু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন ও স্থানীয় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। যেমন ওয়াহাবী আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের প্রতিরোধ চেষ্টা, দেবী চৌধুরাণী, ফকির সন্নাসী আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে বাংলা ও ভারতীয়দের প্রতিরোধ-প্রতিবাদ পরিলক্ষিত হয়।
১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ এ দেশে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, এরা ভারতীয়দের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়। অতঃপর ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রতিশ্রুত। কিন্তু ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ কার্যকর ও স্বদেশী আন্দোলনে রাজনৈতিক চেতনা পরিলক্ষিত হয়।
বিশ্বকবির ভাষায় ‘ইউরোপীয় অভিঘাতে ভারতবর্ষের অচলায়তনে আঘাত পড়লে নানামুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়’ [সূত্র: কালান্তর-৮]। রাজনৈতিক মনোভাব প্রদর্শন ও আন্দোলনে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে ঊনিশ শতক থেকে বাঙালি নিজেকে জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করে । ইতোমধ্যে আমাদের আালোচনায় কিছু উদাহরণ দিতে চেষ্টা করেছি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আগমনে প্রথম আলোচিত হয় বাঙালি জাতি।
১৮৫৬ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি গঠন এবং এর পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা, অন্যদিকে ১৮৭২ সালের প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক একটি আদমশুমারি করলো ইংরেজ শাসকরা। দেখা গেল পূর্বাঞ্চলের জনগোষ্ঠীতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অতএব, পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক অনগ্রসরতার অজুহাতে লর্ড কার্জন ঢাকাকে রাজধানী করার উদ্যোগেই ১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। এতে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেন। যা কার্জনের একটি উক্তিতে পরিষ্কার হয়। ১৯০৪ সালের কার্জনের ডায়েরিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে ‘বাঙালিরা নিজেদের, যারা একটি জাতি বলে ভাবতে পছন্দ করে, যারা এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, যখন ইংরেজদেরকে বিদায় করে দিয়ে কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউজে একজন বাঙালি বাবুকে অধিষ্ঠিত করবে’ [সূত্র: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-১৫]। তারা ভাবলো, বাঙালিরা একত্রে থাকলে এতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে যে ওদের আর সামলানো যাবে না। প্রশাসনিক সুব্যবস্থা আনায়নের কথা বলে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর, ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা প্রদেশ সৃষ্টি করে। এতে পশ্চিম বঙ্গের অভিজাত শ্রেণিসহ বিরাট অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় নামে। শুরু হয় প্রবল আন্দোলন। স্বদেশী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘ঘরে বাইরে’ এমনকি স্বদেশ পর্যায়ের প্রথম কবিতা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’, যেটি এখন বাংলাদেশের ‘জাতীয় সংগীত’। বঙ্গভঙ্গের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি করে। ১৯০৬ সালে জন্ম হয় মুসলিম লীগের। শীল সেন লিখলেন “ঞযব চধৎঃরঃরড়হ ধহফ রঃং ধহহঁষসবহঃ রিঃযরহ ষবংং ঃযধহ ফবপধফব যধফ ভড়ৎ ৎবধপযরহম পড়হংবয়ঁবহপব ড়হ ঃযব ংযরঢ়ঢ়রহম ড়ভ গঁংষরস ঢ়ড়ষরঃরপং.” [গঁংষরস চড়ষরঃরপং রহ ইবহমধষ-১৯৩৭-১৯৪৭, ঢ়ধমব-৩১]।
মুসলিম লীগের প্রথম কয়েক দশক গেল শুধু সাম্প্রদায়িক চিন্তায়। জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয়দের স্বার্থে অগ্রবর্তী হতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সেখানে মধ্যমপন্থি (গড়ফবৎধঃব) ও চরমপন্থি (ঊীঃৎবসরংঃ)। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলনের তীব্রতায় ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দিল। শুধু তাই নয়, কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করলো। ব্রিটিশ আনুগত্যে বিশ্বাসী আশরাফ মুসলমানরা মুসলিম লীগে পরিবর্তন এনে কংগ্রেসের সাথে কিছুদিন পথ চললো। ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তি, জালীয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, খেলাফত অসহযোগে একত্রিত থাকা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে স্বরাজপার্টি ও বঙ্গীয় চুক্তিতে অনেক প্রতিনিধিত্বশীল মুসলিম যোগ দেয়া পর্যন্ত হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি লক্ষ্য করি। এতে ভারতবাসীর স্বাধীনতার পথ দোটানায় প্রবাহিত হলো। এদিকে দেশবন্ধুর মৃত্যু ও অসহযোগ নেতাদের আসল পশ্চিমপন্থি সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর আবির্ভাব হিন্দু-মুসলিম ধারাকেই স্পষ্ট করে তোলে। এমনকি উচ্চশিক্ষিত ইকবাল (পাঞ্জাব ব্যবস্থাপক সভার সদস্য-১৯২৭), কবি একসময় বলতেন “ভারতকে বলেছিলেন “যারা দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ”। তিনিই ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে বললেন- ইসলাম ধর্মের উপর জাতীয়তাবাদ দাঁড় করিয়ে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের চারটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের ধারণা দেন [সূত্র: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-৭৪] ।
ক্যামব্রিজে পাঠগ্রহণরত চৌধুরী রহমত আলী সেই মতকে বিস্তৃত করলো। আর ১৯৪০ সালের লাহোরে মুসলিম লীগের শেরে বাংলা খ্যাত ফজলুল হক পাকিস্তানে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রস্তাব করেন। পরে ১৯৪৬ সালের রাষ্ট্রসমূহের স্থলে রাষ্ট্র করে লেখা হয়েছিল। এই হলো মুসলিম লীগের স্বাধীনতার আগে ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্ব। আগে ভাগ পরে স্বাধীনতা। আর কংগ্রেস- আগে ভারত ছাড়। এই টানাপোড়নে ‘ভাগেই স্বাধীনতা’। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ভারত-পাকিস্তান। পাকিস্তানের গঠনের একটি অদ্ভূত দিক, দুটি অংশ পূর্ব-পশ্চিম। হাজার মাইল দূরে। সাদৃশ্য শুধু অধিকাংশই মুসলমান। ভাষা সংস্কৃতি আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোভাব উপ-উপনিবেশিক। পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি অবহেলা, অমর্যাদা ও শোষণ। অথচ তারা ভুলিয়ে দিতে চাইলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শুধু মুসলমান নয়, তারা বাঙালিও। ড. শহীদুল্লাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে উল্লেখ করলেন “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা, ”[সূত্র: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-৬৪] । পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার মর্যাদা না দেয়ার চেষ্টা প্রতিফলিত হয় ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসে, আসে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। ১৯৭১ সালের পূর্বে ব্রিটিশ শাসক থেকে পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের সাথে স্বাধীন হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে ১৯৫৭ সালে পলাশীতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এ দেশ ও জনপদে আমরা কত স্বাধীন রাজা, সুলতান ও সুবেদারের পরিচয় পাই। এ সমস্ত শাসকদের ছিল মুদ্রা, খুৎবা বা তাম্র শাসন। বহুবার তারা কেন্দ্র থেকেও স্বাধীন ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুনকে পলাশী দিবস পালন করে। ঐদিনকে স্মরণীয় করার জন্য আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিন ২৩শে জুন পালন করা হয়। এ দেশে ও জনপদে রাজা-শাসক, নবাব-সুলতান ও সুবেদার যারাই রাজত্ব করেছেন তারা কখনো স্থায়ীভাবে স্বাধীন ছিলেন না। এমনকি তাদের দাপ্তরিক ভাষাও বাংলা ছিল না। উপরন্তু বাঙালিত্বকে ধারণ করেন নি। তাদের জাতীয়তাবাদী ধারণাই ছিল না। সেই সময় বংশে-রাজবংশে, উত্তরাধিকারে- সিংহাসন মসনদের পালা বদল বা ষড়যন্ত্রেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হতো।
ধারাবাহিকভাবে স্বাধীনতার যে প্রত্যাশা- এতদিন পর্যন্ত বাঙালি যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে তা ব্রিটিশদের থেকে পাওয়া স্বাধীনতা পাকিস্তানি শাসনের মধ্যে অর্জিত হয়নি। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য যে প্রত্যাশা তার বুনিয়াদ হয় ভাষা আন্দোলনের সূচনার মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের ভিত রচনায়। বাঙালি সংস্কৃতির বুনিয়াদ ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯ দফা ইশতেহারে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে নৌকা প্রতীকের মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে, ১৯৬৬ সালের মুক্তি ও স্বাধিকারের (৬ দফা) আন্দোলনে, ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির আন্দোলন ও মুক্তি, ১৯৬৯’র গণ-অভ্যূত্থান এবং ৭০’র নির্বাচনে আবারো নৌকা প্রতীকের জয়লাভে বাঙালি মুক্তি ও স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছালো। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জনে বাঙালির কাঙ্ক্ষিত মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি যে ৪৭ পরবর্তী ৫২ থেকে ৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি সংস্কৃতি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র জাগরিত হয়েছে তার পেছনে বাংলার অনেক রেনেসাঁ পুরুষের অবদান রয়েছে। বাংলার অনেক কবি, সাহিত্যিক ও স্বাধীনতাকামী বাঙালির অবদান ছিল বাঙালির এই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি ও স্বাধীনতায়। পৃথিবীর ইতিহাসে যেগুলো স্বাধীনতাকামী স্বাধীন দেশ বা জাতি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই জাতির পিতা এবং স্বাধীনতার ঘোষক রয়েছে। আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মাহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আহামেদ সুকর্ণ, মার্শাল টিটো এরা প্রত্যেকেই নিজ দেশের জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃত এবং এ বিষয়ে কোনো বিতর্র্ক নেই। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা স্বাধীনতার ঘোষক এবং জাতির পিতা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, মুক্তি ও স্বাধীনতার নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে চায় সেই ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত মহল। পৃথিবীর অন্যনা্য গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম আর বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালি অংশ নেয়, বঙ্গবন্ধুর অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নে ও মুক্তির প্রত্যাশায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে রাজনৈতিক দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছেন তা মফস্বল থেকে মেট্রোপলিটন, রাজধানী-কলকাতা, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের অভিজ্ঞতা, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও পাকিস্তান উপ-উপনিবেশবাদ থেকেও শিক্ষা নিয়েছেন। তাঁর হাতেই বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কথিত আছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।
হঠাৎ যেন সব থমকে গেলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। বাঙালি জাতি প্রত্যক্ষ করলো, কিছু বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তা, দেশী ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পরিচালিত ইতিহাসের নির্মম ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। দেশ, জাতি ও বিশ্ব বড় ধরনের প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হল। বাঙালির যে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল তা বঙ্গবন্ধু পেলেন না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও স্বাধীনতা চেতনা বিরোধীদের দ্বারা দেশ যেন উল্টো পথে পরিচালিত হল। বাঙালির ভাগ্যাকাশে বাংলাদেশ নামক উজ্জ্বল প্রদীপ যখন প্রায় নিভু নিভু অবস্থায় ঠিক তখনি ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন সেদিনের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। জননেত্রী শেখ হাসিনা হাল ধরলেন আওয়ামী লীগের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রীর। তিনি বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ করছেন এবং বঙ্গবন্ধুর যে মুক্তির দেশ, সে দেশের অনেক অর্জনে শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। অনেক সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত দেশ মুক্তির নোঙরে পৌঁছাতে সক্ষম। আমরা মাঝে মাঝে স্বাধীনতা চেতনা নিয়ে হোঁচট খেয়েছি এবং বাধাগ্রস্ত হয়েছি। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করতে চেয়েছে স্বাধীনতা লগ্ন থেকেই। তাঁর অবদানকে বিতর্কিত করতে চেয়েছে সবসময়ই। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরলে একে একে সম্পন্ন করেন বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যার মধ্য দিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়। বর্তমানে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। দেশের অর্থনীতির ভীত শক্ত হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছি। স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে।
লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধগণহত্যা দিবসে বিজয়-৭১ এর আলোচনা সভা