স্বপ্নজয়ী কন্যারা নিজের মতন করে বাঁচো

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী | বুধবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়ি অঞ্চলে তাদের বসবাস, একবেলা মুখে খাবার তুললো তো আরেকবেলা থাকে উপোস। খুব ভোরবেলা তাদের ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচির শব্দে। তাদের প্রত্যেকেরই জীবনের গল্প অনেক দুর্বিসহ, অনেক কষ্টের! সেই কষ্ট থেকে বেরিয়ে তারা স্বপ্ন দেখেছিলো একটি সোনালি দিনের, স্বপ্নকে তারা জয় করলো।
বলছিলাম সাফ ফুটবল শিরোপা জয়ী বাংলাদেশের মেয়েদের কথা, যারা সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নতুন ইতিহাস গড়লো। হিমালয় কন্যা নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করলো। নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে জিতে নিলো সাফ ফুটবল শিরোপা।

নিজেদের লালিত স্বপ্নকে জীবনবাজি রেখে সত্যি করে তুললো আমাদের বীর কন্যারা। দেশের জন্য বয়ে আনলো বিরাট সম্মান। সমাজের কটাক্ষ, পরিবারের অসচ্ছলতা, দারিদ্র, হতাশাকে পাথর চাপা দিয়ে ছিনিয়ে আনলো জয়ের মুকুট। ফুটবলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, দৃঢ় মনোবল আর প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে হেরে গেলো সামাজিক পারিবারিক প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা।

এই ফুটবল কন্যাদের যে দল তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের একটি প্রত্যন্ত এলাকার আর বাকিরা চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি থেকে উঠে আসা।

তাদের এই পথচলা কিন্তু খুব সহজ ছিলো না। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তাদেরকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ছিনিয়ে এনেছে জয়ের পতাকা।

তাদের এই পথচলা শুরু হয়েছিলো ২০১১ সালে, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে। এরপর আর থেমে থাকেনি। জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিলো। বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছিলো। তাদের এই জীবনযুদ্ধ এবং সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়টি। এই বিদ্যালয় থেকে প্রতিবছরই অনেকেই যুক্ত হচ্ছে জাতীয় নারী ফুটবল দলে। তাইতো বিদ্যালয়টি ফুটবলার তৈরির আস্ত কারখানা হিসেবে পরিচিত।
অথচ এদের প্রায় সবারই জীবন চলে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে। কোনোরকমে খেয়ে পরে দিন যাপন করে। কারও মা রাস্তায় কাজ করেন, কারো বাবা রিক্সা চালান কেউ বা আবার কৃষিকাজ করেন।

তাদের এই সাফল্যের পেছনে যাদের অবদান সবচাইতে বেশি তারা হলেন কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। তাদের মধ্যে দুজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তারা হলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল এবং শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন। মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা বুঝিয়েছেন তাদের মা-বাবাকে ফুটবল সম্পর্কে। মা-বাবারা ভাবতেন মেয়েরা ফুটবল খেললে তাদের বিয়ে হবে না, সমাজ তাদের ভালো চোখে দেখবে না, বদনাম হবে। এধরণের বদ্ধমূল ধারণা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে গেছেন এই শিক্ষকেরা। এইজন্য তাদেরকেও কম কষ্ট করতে হয়নি যেভাবে পেরেছেন সেভাবে মেয়েদের সাহায্য করে গেছেন। শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানাই সেইসব শিক্ষককে।

অস্বীকার করা যাবে না, আমাদের সমাজ বা পরিবারের মানুষজন এখনও মেয়েদের খেলাধুলাকে তেমনভাবে সমর্থন করে না। ভাবে কী হবে খেলে? মেয়েরা তো ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ করবে, রান্নাবান্না করবে সেইতো বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করতে হবে, তারা কেন বাইরে গিয়ে ফুটবল খেলবে! কিন্তু এই অদম্য উৎসাহী সাহসী মেয়েরা শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়, কিভাবে নিজের সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কিভাবে নিজের দেশের হয়ে প্রাণপণ লড়ে যেতে হয়।

আসলে আমাদের দেশে মেয়েদের খেলাধুলা করাটা অনেক কঠিন। প্রথমত পরিবার, সমাজ কেউই মন থেকে চায় না মেয়েরা খেলুক, দ্বিতীয়ত খেলার তেমন কোনো জায়গা নেই, সুযোগ সুবিধা নেই। গ্রামের মাঠগুলোতেও মেয়েদের খেলাধূলা করার কোনো সুযোগ দেয়া হয় না। মেয়েরা ফুটবল খেলতে চাইলেও পারে না সেইক্ষেত্রে স্কুল কলেজগুলো থেকেও তারা খুব একটা উৎসাহ পায় না। স্কুল কলেজগুলো যদি তাদের খেলার সুযোগ করে দেয়, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে মেয়েরা অনেকদূর এগিয়ে যাবে। এই ঘুনে ধরা সমাজ পুরুষদের সুযোগ সুবিধা দিতে মোটেও কার্পণ্য করে না শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে যত অবহেলা। তারপরেও এই অবহেলিত মেয়েরাই দেখিয়ে দিলো তারা কতটা পারে আর কতটা পারে না।

আসলে এই ছোট ছোট মেয়েগুলো আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়ে দিলো। বুঝিয়ে দিলো কিভাবে সমস্ত বাধাকে তুচ্ছ করে উন্নতির চরম শেখরে পৌঁছানো যায়, গড়ে তোলা যায় নতুন ইতিহাস। এই ফুটবল কন্যারাই সমগ্র জাতির জন্য উদাহরণ হয়ে রইলো। মেয়েরা যে সমস্ত বাধাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে সেটাই প্রমাণ করলো। তারা যদি এতবড় সাফল্য অর্জন করতে পারে তাহলে আমাদের দেশের অন্য নারীরা কেন পারবে না সমস্ত অন্ধকারকে পেছনে ফেলে আলোর পথে এগিয়ে যেতে, নিজের ভুবনটা নিজের মতন করে গড়ে নিতে। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতাকে পেছনে ফেলে জেগে উঠতে হবে নারীদের। তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অত্যাচার এবং প্রতিবন্ধকতাকে নির্ভয়ে আপন শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে, তবেই তারা জয়ী হবে, নিজেদের মানুষ ভাবতে শিখবে।

এই স্বর্ণকন্যাদের মধ্যে একজন হলো সানজিদা, নেপালের সাথে ফাইনাল খেলার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলো, ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়। এগারজনের যোদ্ধা দল মাঠে থাকবে। যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে। অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধে লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাবো’।

অবাক হই কী দৃঢ়চেতা, কঠিন মনোবল তাদের, চোখের পানি ধরে রাখা কষ্টকর। সাবিনা, কৃষ্ণা, নিলুফা, রুপনা, মনিকা, সানজিদারা সবাই শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে, হেরে যাইনি, জিতেই দেখালো। এই দৃঢ়চেতা সোনার মেয়েরাইতো নিজের ভবিষ্যৎ জীবনটাকে স্বর্ণোজ্জ্বল করে তুলবে। এই ফুটবল কন্যারা আজ যে সাফল্য এবং সুনাম বয়ে আনলো দেশের জন্য হয়তো তার পথ ধরেই এগিয়ে যাবে আমাদের নতুন দিনের মেয়েরা, নারী জাগরণের পথে এগিয়ে যাবে বেশ কয়েক ধাপ, শুরু হবে নতুন অধ্যায়ের।

আজ তাদের এই জয়ের আনন্দে আনন্দিত, উল্লসিত দেশবাসী। তাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ। নারী বলে যাদের একসময় অবজ্ঞা করা হতো, মেনে নিতে পারেনি নারীরা ফুটবল খেলবে তারাও আজ মাথা নত আমাদের স্বর্ণকন্যাদের কাছে।

পুরুষ খেলোয়াড় এবং নারী খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক নিয়েও বৈষম্য। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম নারী খেলোয়াড়দের যে পারিশ্রমিক দেয়া হয় সেটা পুরুষ খেলোয়াড়দের তুলনায় খুবই নগণ্য। এভাবেই তারা প্রতিনিয়ত ঘরে বাইরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সব জায়গায় পুরুষেরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। হয়তো মেয়েদের এই বিজয়ের পথ ধরেই একদিন সমস্ত বৈষম্য দূর হবে, নিজেদের অধিকার নিয়ে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

আমাদের মেয়েরা সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিলো, সার্থক হয়েছে তাদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় এখন তাদের অবস্থান। তারা আকাশ ছুঁতে চেয়েছিলো, আকাশ ছুঁয়েছে। যাদের স্বপ্ন এত সুন্দর, যাদের মনোবল এতটা দৃঢ়, যারা প্রতিজ্ঞবদ্ধ তাদের স্বপ্নের কাছে তারাইতো পারবে সমাজের শিকল ভেঙে নিজেদের বিজয় ছিনিয়ে আনতে।

আর পেছনে তাকানোর সময় নেই। এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। হয়তো তাদের মধ্য থেকেই উঠে আসবে নতুন দিনের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। তোমাদের অভিবাদন আমাদের স্বপ্ন কন্যারা। তোমরা জয় করেছো তোমাদের স্বপ্নকে, তাইতো তোমরা স্বপ্নজয়ী। তোমরা কখনও তোমাদের স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত হইয়ো না, আমরা যে তোমাদের স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে চাই। তোমরা নিজের মতন করে বাঁচো আমাদের স্বপ্নজয়ী কন্যারা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ-মানুষ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে