স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক নিয়ে পুরনো পথেই বিপিসি

বেসরকারিভাবে মহাব্যবস্থাপক নিয়োগের সিদ্ধান্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি আপত্তি ওঠা ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এক বছর না পেরুতেই স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) থেকে ব্যাকফুটে সরতে শুরু করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। ইতোমধ্যে নতুন করে বেসরকারিভাবে মহাব্যবস্থাপক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। উপরন্তু বাণিজ্যিক অডিটে আপত্তি ওঠা ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অভিভাবক প্রতিষ্ঠান।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুদক হটলাইনে আসা এক অভিযোগের সূত্র ধরে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে ৫৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তরের প্রমাণ পায় দুদক। ওই ঘটনার পর ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয় ও অডিটসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি। এ নিয়ে ওই বছরের ২৬ জুলাই দৈনিক আজাদীতে ‘হাজার কোটি টাকা লোপাট! স্টান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড; প্রাথমিক পর্যায়ে দুই কর্মকর্তার বেনামি ব্যাংক হিসাবে ৫৭ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের সত্যতা পেয়েছে দুদক’ শীর্ষক মূল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীতে বিপিসির তদন্ত কমিটি এসএওসিএলের অসহযোগিতার অভিযোগ এনে তদন্ত প্রতিবেদন দেন। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের শুধুমাত্র নমুনা ভিত্তিক কিছু আর্থিক কার্যক্রমের অনুসন্ধান করে প্রায় তিনশ কোটি টাকার অনিয়মের সত্যতা পায় কমিটি। এ নিয়ে গত বছরের ৭ জানুয়ারি ‘স্যাম্পল তদন্তে ৩০০ কোটি টাকার অসঙ্গতি; স্টান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি; সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই বিপিসির’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর তদন্ত প্রতিবেদনটি দুদকে পাঠায় বিপিসি। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. শাহেদ।
এদিকে বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ৯ মার্চ প্রায় ৮১ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। আগেই মারা যাওয়ায় মহাব্যবস্থাপক শাহেদকে মামলায় আসামি করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে এসএওসিএলের ২০১৩-২০১৪ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছর পর্যন্ত এবং ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের অংশ বিশেষের উপর নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তর। গত বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা কাজ শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেন নিরীক্ষা দলের নেতা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের চিফ একাউন্টস অ্যান্ড ফাইনান্স অফিসার নারায়ন চন্দ্র সাহা। বাণিজ্যিক ওই অডিটে কোনোপ্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ইচ্ছেমত সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে ১৪ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার গুরুতর অনিয়ম উত্থাপন করা হয়। অভিযোগ উঠা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন- সিনিয়র অফিসার (মেইনটেনেন্স) মো. শহিদুল ইসলাম, জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল) দুর্জয় দে, অফিসার (হিসাব) মো. ফখরুল ইসলাম, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনোয়ার জাহিদ, সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তী, জুনিয়র সেলস অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌ ও অপা.) মো. মোকাররম হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. মাহমুদুল হক, জুনিয়র অফিসার (অপারেশন) মো. সামীম সহিদ, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনিসুর রহমান, অফিসার (এইচআর) আবদুল্লাহ আল মামুন, অফিসার (সেলস) মীর হোসেন, ম্যানেজার (প্রোডা ও অপা.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান ও অফিস সহকারী মো. আশরাফ উদ্দিন। অনুমোদনহীনভাবে ৫০ কোটি টাকার এফডিআর ভাঙিয়ে ৯৪ লাখ টাকা তছরুপ, বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই এসএসসি পাস না করা লোককে সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগ, এসএওসিএলের টাকায় আমদানিকৃত দুটি লিফট সাবেক জিএমের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে লাগিয়ে দেওয়া, মেশিন আমদানির নামে বিদেশ সফর, অনুমোদনহীন গাড়ি ব্যবহার করে অর্থ অপচয়সহ নানান অভিযোগ রয়েছে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া, ৩০ বছরের অধিক বয়সীদের অফিসার হিসেবে নিয়োগ, চাকরিচ্যুত হওয়ার কয়েক বছর পরে নিয়মবহির্ভূতভাবে পুনরায় নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে অডিট আপত্তিতে।
এদিকে মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদ মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রথমে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) শহীদুল আলমকে প্রধান নির্বাহী করা হলেও পরবর্তীতে বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোরশেদ হোসাইন আজাদকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দেন বিপিসি চেয়ারম্যান। এরপর থেকে নানান অনিয়ম বন্ধের পাশাপাশি লোকসানি বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে নানান প্রভাবে বর্তমানে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকে বিপিসি। উপরন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এসএওসিএলের গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন না এনে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বিপিসির বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, গঠনতন্ত্রে যাই থাকুক অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসএওসিএলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বসাতে পারে বিপিসি। বিপিসি সেদিকে অগ্রসর না হয়ে আবারো পুরনো পন্থায় বেসরকারিভাবে মহাব্যবস্থাপক নিয়োগের দিকে এগুচ্ছে। এতে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ হারানোর সুযোগ তৈরি হবে। বিপিসির উচিৎ, গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে বিপিসি কিংবা অধীনস্থ অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবে বিপিসি। অনিয়মও দূর করা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসি পরিচালক (অর্থ ও বিপণন) ও এসএওসিএলের পরিচালক কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি কিংবা নতুন মহাব্যবস্থাপক নিয়োগের বিষয়টি এসএওসিএলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন। বিষয়গুলো সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে তেমন অবগত নন বলে জানিয়ে তিনি উপ-মহাব্যবস্থাপক মোরশেদ হোসাইন আজাদের সাথে কথা বলতে বলেন।
এ বিষয়ে এসএওসিএলের পরিচালনায় বিপিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোরশেদ হোসাইন আজাদ বলেন, এসএওসিএল যেহেতু অংশীদারি প্রতিষ্ঠান, সেখানে আমরা বিপিসির স্বার্থই নিশ্চিত করব। প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের সিদ্ধান্তক্রমে মহাব্যবস্থাপক নিয়োগের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে অডিট আপত্তির পরেও ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে বিপিসি ও এসএওসিএলের চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ শনিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, বাণিজ্যিক অডিট আপত্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অডিট আপত্তিতে কারো ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব থাকলে সেগুলো দেখার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপকীয় প্রধানের কাছে। এ ধরনের আপত্তি থাকলে তিনি বিষয়টি বোর্ডে উত্থাপন করবেন। ম্যানেজমেন্ট যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটি যদি নিয়মতান্ত্রিক হয়, তাহলে সেটাকে আমরা সমর্থন করব। নতুন মহাব্যবস্থাপক নিয়োগের বিষয়টি একটি প্রশাসনিক অংশ বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, এখানে বিপিসি থেকে একজনকে সাময়িক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মহাব্যবস্থাপক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে তিনি বিপিসিতে ফিরে আসবেন। বিপিসির নিয়ন্ত্রণটা একেকজনের কাছে একেক ধরনের হতে পারে। মহাব্যবস্থাপক নিয়োগের সাথে এর সম্পর্ক নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহত্যা করে লাশ কর্ণফুলীতে!
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আল্লামা সাবির শাহ