সোনাদিয়া দ্বীপে শিয়াল এলো কোত্থেকে

কক্সবাজার প্রতিনিধি | সোমবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

এখন সন্ধ্যা নামলেই সোনাদিয়া দ্বীপে শোনা যায় শিয়ালের ডাক। অথচ মাত্র এক দশক আগেও এই দ্বীপে পাখি, সরীসৃপ ও সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়া অন্য কোনও বন্যপ্রাণীর দেখা মিলতো না। কিন্তু চারিদিকে জলরাশি ঘেরা এই সোনাদিয়া দ্বীপে শিয়াল এলো কী করে – প্রশ্নটি প্রায় শোনা যায় পর্যটকসহ দ্বীপের নতুন আগন্তুকদের কাছ থেকে।

কক্সবাজার শহর ও মহেশখালী দ্বীপের মাঝখানে বঙ্গোপসাগরে গড়ে ওঠা সোনাদিয়া দ্বীপটি কক্সবাজার শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র এক মাইল চওড়া একটি চ্যানেল দ্বারা বিভক্ত এই দ্বীপটি মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড মাত্র। ‘স্বর্ণ দ্বীপ’ নামেও পরিচিত এই দ্বীপটিতে বাস করে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। কথিত রয়েছে, একসময় এই দ্বীপে স্বর্ণ পাওয়া যেতো বলে দ্বীপটির এমন নামকরণ।

বাংলাদেশ ভ-ূতাত্ত্বিক জরিপে এখানকার বালিতে মোনাজাইটসহ মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে। প্রায় ১০ হাজার একর আয়তনের এই দ্বীপটিতে এখন প্রচুর পর্যটক আসছেন এবং ঝাউবাগানে তাঁবুতে রাত যাপন করছেন বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য একরাম মিয়া। তিনি বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপে নতুন আসা সকলের প্রশ্ন- এখানে শিয়াল এলো কোত্থেকে এবং কী করে?

ইউপি সদস্য একরাম মিয়া বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপে কখনও শিয়াল ছিল না। কিন্তু ৭/৮ বছর আগে এই দ্বীপে প্রথম শিয়াল দেখা যায়। শুরুতে এক-দুটি শিয়াল দেখা গেলেও এরপর ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন সোনাদিয়া দ্বীপে শিয়ালের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পরিবেশবাদী বেসরকারি সংস্থা নেকমের জেলা ব্যবস্থাপক ও মেরিন বায়োলজিস্ট আবদুল কাইয়ূম বলেন, আমরা প্রায় ১৫ বছর আগে এই দ্বীপে প্রথম যখন কার্যক্রম শুরু করি তখন পাখি, সরীসৃপ ও সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়া শিয়াল কিংবা অন্য কোনও বন্যপ্রাণীর দেখা পেতাম না। কিন্তু প্রায় ৮ বছর ধরে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। দ্বীপের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম অংশ পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে এরা রাতের বেলায় দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করে। তবে কখনও কোনও মানুষকে আক্রমণ করতে দেখা যায়নি।

তিনি জানান, শিয়ালেরা মৃত প্রাণী এবং ইঁদুর ছাড়াও লাল কাঁকড়া খেতে পছন্দ করে। শিয়ালের দল লাল কাঁকড়ার গর্তে লেজ ঢুকিয়ে দিয়ে কাঁকড়া শিকার করে খায়।

নেকমের উপ প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান জানান, শিয়ালের দল কচ্ছপের ডিম খেয়ে ফেলে। শিয়ালের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সোনাদিয়ায় দ্বীপে কচ্ছপের ডিম পাড়ার হার আশংকাজনক হারে কমে গেছে।

তিনি জানান, ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়েক প্রজাতির কাছিম এ দ্বীপে আসতো এবং বছরে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার পর্যন্ত ডিম পাড়তো। আর গত মৌসুমে এই সংখ্যা ছিল এক হাজারের কম। তাছাড়া চলতি মৌসুমে এখনও কাছিমের ডিম পাওয়া-ই যায়নি।

তবে সোনাদিয়া দ্বীপে শিয়ালের আগমন নিয়ে শোনা গেল ভিন্ন ভিন্ন গল্প।

কারো কারো মতে, মূল ভূ-খণ্ড থেকে শিয়ালকে ধরে বনবিভাগ কিংবা অন্য কোনও পরিবেশবাদী সংস্থার লোকজন গোপনে সোনাদিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে। কারো কারো মতে, মহেশখালী থেকে ভাটার সময় নদী পার হয়েই সোনাদিয়ায় এসেছে শিয়াল। তবে স্থানীয় ইউপি মেম্বার একরাম মিয়ার মতে, প্রায় এক দশক আগে কুতুবজোম-সোনাদিয়া ব্রিজ নির্মাণের পরই মহেশখালী থেকে ব্রিজ দিয়েই পার হয়েছে শিয়ালেরা। এরপর ব্রিজটির এ্যাপ্রোচ রোডের ভাঙনের কারণে স্থল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে শিয়ালের দল সোনাদিয়ায় আটকে পড়ে এবং বংশ বৃদ্ধি করে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, শত শত বছর ধরে মহেশখালী দ্বীপের বনাঞ্চলে শিয়ালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হতে পারে, ভূমিকম্পে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে মহেশখালী কক্সবাজারের মূল ভূ-খণ্ডের অংশ ছিল এবং তখন সেই বনাঞ্চলে শিয়ালও বিচরণ করত। আবার বরফ যুগে যখন সমুদ্রসীমা অনেক নীচে নেমে যায়, তখন মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নকারী চ্যানেলটি শুকিয়ে গিয়ে স্থলপথে মূল ভূ-খণ্ডের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে মহেশখালী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপটিয়ায় আগুনে পুড়ল ১২ বসতঘর
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপি নেতার বোনের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত : জানতো না মন্ত্রণালয়