বিশিষ্ট কলামিস্ট, লেখক, সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ। যথাযথ কারণেই তার গুণগ্রাহীরা মিডিয়ায় মকসুদের লেখালেখি ও একটিভিস্ট ইমেজ নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন। এই সূত্রে আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই যারাই গবেষণকেন্দ্রিক বই পাঠ করবেন, লিখবেন তাদের স্মৃতিতেও মকসুদের কাজের ছাপ রয়ে যাবে। মকসুদ জীবনীমূলক গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন বেশ কয়েকজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের উপর। যেমন, ‘মওলানা ভাসানী’, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, ও ‘বুদ্ধদেব বসু’। তাদের জীবনী তিনি তৎকালীন সমাজের নিরিখে বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রকারান্তে সমাজেরই বিভিন্ন বিশ্লেষণ করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী সি রাইট মিলসের মতে সমাজতত্ত্বের উৎকর্ষ সাধনের জন্য এটি এক জরুরি পদ্ধতি। মকসুদের ‘সক্রিয় যাপিত জীবন’ যাতে যিনি বিভিন্ন ঔপনিবেশিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে হাজির করেছেন – তা হয়ত ভবিষ্যতের গবেষকরা বিশ্লেষণ করবে। তাতে গবেষকরা স্বয়ং মকসুদেরই পদ্ধতিগত সততার আশ্রয় নিতে পারে। এখানে আমি বুদ্ধদেব বসুর ঢাকা জীবনের উপর লেখা আবুল মকসুদের বই ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’ এর আলোকে আলোচনা করছি।
অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর বিষয় :
বিশিষ্ট, খ্যাতিমান ব্যক্তির জীবন গবেষণা করতে গেলেই অনেক অপ্রিয়, অস্বস্তিকর বিষয়ে আলোকপাত করতে হয়। ভক্তরা যতই নিখুঁত ইমেজ কল্পনা করুক না কেন, ব্যক্তির যাপিত জীবনে কিছু না কিছু থাকে যা সেই ইমেজকে অনভিপ্রেতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এক্ষেত্রে মকসুদ সোজাসুজি জবাব দিয়েছেন, আধুনিকতার অপর মানে হলো সত্যানুসন্ধান। তাই ব্যক্তি বুদ্ধদেবের পিতার সাথে শীতল সম্পর্ক, কলকাতা গমনের পর ঢাকার সাথে অনেকটা সম্পর্কছেদ, রাজনৈতিক বিমুখতা এবং মুসলমান সমাজের সাথে সম্পর্কের কথা মকসুদ এড়িয়ে যান নি। তবে, স্পর্শকাতর বিষয়ে মকসুদ যথাযথ তথ্যভিত্তিক আলোচনা করেছেন, সতর্কভাবে তার নিজের মতামত বসুর উপর আরোপ করা থেকে বিরত থেকেছেন।
একান্ত অনুভূতি :
জীবনীভিত্তিক সমাজ বিশ্লেষণের এক আকর্ষণীয় দিক হলো ব্যক্তির একান্ত অনুভূতি লোকসম্মুখে নিয়ে আসা। ব্যক্তি জীবিত না থাকলে তা বেশ কঠিন হয়ে যায়। তবে কঠিন ঠাহর করে মকসুদ সেই পথ এড়িয়ে যান নি। বিভিন্ন বিষয়ে বসুর মতও আচরণ জানতে বসুর লেখা (এমনকি চিঠিপত্র), কাছের পরিবার, শিক্ষক, সমসাময়িক অন্যান্য লেখক – এরকম নানা উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তথ্য একের অধিক উৎস দিয়ে মিলিয়ে দেখেছেন। এতে মকসুদ পূর্বের বিভিন্ন লেখকের তথ্যের ভুল শুধরে দিতে কার্পণ্য করেননি।
পরিবার, পরিজন, প্রকৃতি :
পরিবারের ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা, অর্থনৈতিক অবস্থা, চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ সবই লেখকের গঠনমূলক জীবনেরই অংশ। তবে লেখক জীবনের উপর এসবের প্রভাব সরাসরি নির্ণয় করা জটিল। মকসুদের বিস্তারিত গবেষণা সেই জটিলতা উতরাতে পেরেছে অনেকটা। যেমন, পুরানা পল্টনে বুদ্ধদেব বসুর আবাসস্থলের গাছ-গাছালি, পাখপাখালির, কাছের বাড়ির বাগান, অর্থনৈতিক অবস্থান সবই এসেছে মকসুদের গবেষণায়। বসু পরিবারের সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়নের ধারা যে বসুর শেষ জীবনের রামায়ণভিত্তিক রচনায় প্রভাব ফেলেছে তাও মকসুদের নজর এড়ায়নি। তবে এসব প্রভাব নির্ণয় করেছেন সরাসরি বসুর লেখায়, যথাসম্ভব এড়িয়ে গেছেন অপ্রয়োজনীয় তৃতীয় পক্ষের বর্ণনা ব্যবহার করার সহজ প্রলোভন।
সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট :
সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট লেখকের রচনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ধরা হয়। তাই, বসুর ঢাকার সময়কার বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তন, রাজনৈতিক চেতনা ও ঘটনার সাথে বসুর যোগসূত্র খোঁজা যথেষ্ট চেষ্টা ছিল মকসুদের। গান্ধীর অহিংস আন্দোলন, স্বদেশ ও স্বরাজ আন্দোলন- ইত্যাদির প্রভাব বসুর লেখায় তেমন ছিল না। তৎকালীন সময়ের ঢাকার সাহিত্য চর্চা, বই বাজার, সাহিত্যিকদের মধ্যকার সম্পর্ক ইত্যাদির কীভাবে বসুর লেখাকে প্রভাবিত করেছে তা মকসুদের চিত্রায়নে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। মকসুদের আলোচনায় বসুর ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সম্পর্কের মূল্যায়নের ভিত্তিতে- ঢালাওভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশেষায়ণ এড়ানোর চেষ্টা প্রশংসনীয়।
শেষে, ব্যক্তি জীবন, সমাজ ও সময়ের মিথস্ক্রিয়ায় কার্যকারণ বের করা যে মুশকিল – তার ব্যাপারে মকসুদ ছিলেন যথেষ্ট সতর্ক। তাই, তিনি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন একই বিষয় বিভিন্ন সূত্রে যাচাই করার। কোন বিষয়ে বসুর ব্যক্তিগত অনুভূতি বসুর কথা ছাড়া অন্য কারো কথা থেকে গড়পড়তা অনুমান থেকে বিরত থাকার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। আশা করি, আজ ও কালের গবেষক ও সাংবাদিকরা মকসুদের পদ্ধতি থেকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাবেন।