নগর উন্নয়নে সেবাসংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি-এ বিষয়ে অনেক দিন আলোচনা চলছে সুধীসহলে। এখানে নগরীর নানা উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে সরকারের ডজনখানেক সেবা সংস্থা। অভিযোগ আছে, সেবা সংস্থাগুলো যে যার মত দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে কাজের কোনো সমন্বয় নেই। এই সমন্বয়হীনতার কারণে সামগ্রিক উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী। এতে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে সময়ে অসময়ে বার বার সমন্বয়ের কথা ওঠে। নানা সভা-সমাবেশে সমন্বয় সভার নামে কথার ফুলঝুড়িও হয়। আবার সভা শেষে সকলেই ভুলে যান। হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সমন্বয় সভার সমস্ত পরিকল্পনা। এ অবস্থায় ‘সিটি গভর্ন্যান্সে’ সমাধান মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদদের।
গত ১ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘সমাধান কি সিটি গভর্ন্যান্সে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগর উন্নয়নে সেবাসংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতে সিটি মেয়রের ‘কর্তৃত্ব’ বা ‘অভিভাবকত্ব’ প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। সেক্ষেত্রে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে মেয়রের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ‘সিটি গভর্ন্যান্স’ ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব আছে নগরপরিকল্পনাবিগণের। যদিও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। এমনকি সমন্বয়ের জন্য সিটি মেয়রের কাছে সেবাদানকারী সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কার্যকর কোনো আইনি কাঠামোও তৈরি করা হয়নি। বিদ্যমান ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ এ সমন্বয়ের সুযোগ থাকলেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়নি। তাই ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে সমন্বয়।অবশ্য ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে যারা সিটি মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা সেবাসংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিতে আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। ওই সময় সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত হতো ‘অর্ডিন্যান্স অব সিটি কর্পোরেশন-১৯৮২’র আলোকে। আইনটির আওতায় প্রথমে সাতটি এবং পরে রেলওয়েসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোকে সিটি মেয়রের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। এমনকি ভূমি অধিগ্রহণসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারতেন তৎকালীন মেয়র। ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার আইনটি রহিত করে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত ক্ষমতাহীন হন মেয়র। ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার সিটি মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন প্রয়াত আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ সময় তিনি মেয়রের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ‘চট্টগ্রাম সিটি গভর্নমেন্ট’ নামে একটি রূপরেখাও তৈরি করেছিলেন। দেশের কয়েকটি সিটির মেয়রদের সাথে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ ব্যবস্থার জন্য তদবিরও করেন। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়নি সরকার। মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর রূপরেখায় ‘সিডিএ, বন্দর, ওয়াসা, রেলওয়ে, পানি উন্নয়নবোর্ডসহ অন্য সেবাসংস্থাগুলোর কর্ম পদ্ধতিতে সমন্বয় সৃষ্টি করে নগরবাসীর সর্বোচ্চ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার’ জন্য ‘চট্টগ্রাম সিটি গভর্নমেন্ট’ ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেন। সেখানে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ এর বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব, আয়ের উৎস, প্রশাসনিক কাঠামো তুলে ধরেন। এতে বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণসহ নয় ক্ষেত্রে সিটি গভর্নমেন্টের জন্য বিশেষ ক্ষমতার প্রস্তাব করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকারের ধারণা বিশ্বের প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রচলিত হলেও আমাদের দেশে এই কনসেপ্টটি একটি ‘নিষিদ্ধ বিষয়’ (ট্যাবু) হয়ে রয়েছে। এ দেশের শাসক মহলে নির্বাচিত মেয়রদের নগর পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে দিতে এক অদ্ভুত অনীহা গেড়ে বসে আছে। এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এ দেশের শহরগুলোর পৌরসভার যতটুকু ক্ষমতা এবং দায়িত্বের পরিধি ছিল পাকিস্তান আমলে এবং বিশেষত আইয়ুব খানের শাসনামলে, সেগুলোও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছরেও ওই ক্ষমতাগুলো আবার সিটি করপোরেশন এবং মিউনিসিপ্যালিটি গুলোতে ফেরত দেওয়ার আইনি পরিবর্তনের গরজ কোনো সরকারের আমলেই দেখা যায়নি।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম চট্টগ্রামে নগর সরকার না হওয়ার কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন তাঁর এক কলামে। সমস্যাগুলো হচ্ছে- মেয়রদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতা ঢাকায় কেন্দ্রীকরণ, মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় বছর অবিশ্বাস্য রকমের কম অর্থ বরাদ্দ, নগরীর মাস্টারপ্ল্যানকে অবহেলা করে প্রায় সব প্রকল্প গ্রহণ, নগরীর গভর্ন্যান্স ও উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৮টি সংস্থা ও এজেন্সির মধ্যে সমন্বয়ের সার্বক্ষণিক সংকট, ড্রেনেজ সমস্যা সমাধানের নামে অপরিকল্পিত প্রকল্পে বিপুল অর্থ অপচয়, স্টর্ম-স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার অভাব, খাল-নালা দখল, কর্ণফুলী নদীদূষণ, যত্রতত্র অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, যত্রতত্র শপিং সেন্টার নির্মাণ, নগরীতে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র ও খেলার মাঠের স্বল্পতা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সিডিএ’র পাল্টাপাল্টি কর্মকাণ্ড।
বিশেষজ্ঞদের এসব মতামত সরকারকে বিবেচনায় আনতে হবে। সেবাসংস্থাগুলোর সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের কতটুকু কাজ সেটা চিহ্নিত করেই সমন্বয় করতে হবে।