দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময়কাল পুরো বিশ্ব ছিল অতিমারী করোনার করাল থাবায় বিপর্যস্ত। সেই বিপর্যয় কাটিয়ে যখন বিশ্ব আবার সচল-স্বাভাবিক হতে চলেছিল সেই সময়ে সামনে আসল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেনকে শিখণ্ডি হিসেবে সামনে রেখে খেলায় মেতেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ইউক্রেনকে ন্যাটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি তাদের কাছে পাত্তা না পাওয়ায় রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে বসেছে। রুশ আগ্রাসনে ইউক্রেন আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে চলেছে। সাধারণ নাগরিকরা জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী পোল্যান্ড, রোমানিয়া, মলদোভাসহ ইইউভুক্ত দেশসমূহে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে ১৫ লাখেরও বেশি শরণার্থী এসব দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অন্য মিত্ররা আমেরিকার সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে চলেছে। এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কায় সারা বিশ্ব। এই যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে। কেউ এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না।
জাতিসংঘ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিন্দা প্রস্তাব পাশ করিয়েছে তাতে বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত ছিল। ভারত, পাকিস্তানও বিরত ছিল। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) আমাদের পক্ষে যে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে এবং সার্বিক অবস্থান নেয় তা জাতি হিসেবে আমরা কখনোই ভুলতে পারি না। জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিপক্ষে যায় এমন প্রস্তাবে একাধিক বার ভেটো দিয়েছে। আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌ বহর পাঠালে সোভিয়েত রাশিয়া পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করে ব্যবহার উপযোগী করে দেয়। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ সঠিক অবস্থানই নিয়েছে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর জোট নিরপেক্ষ কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলনও এতে হয়েছে। যে কোন আগ্রাসনের আমরা নিন্দা জানাই। ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র বিশ্ববাসীর মত আমাদের মনকেও নাড়া দিচ্ছে। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম সবসময় তাদের স্বার্থে প্রচার- প্রচারণা চালায়। এখনও চালাচ্ছে। তারপরও এই যুদ্ধ নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বলে এই অঞ্চলের পাঠকদের মনে হয়। সে রকম কিছু মন্তব্য- বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করলে এ কথাটি নির্দ্ধিধায় বলা চলে, যুদ্ধবাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উসকানিমূলক নানা পদক্ষেপের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এই যুদ্ধ। যার সকরুণ বলি হচ্ছে ইউক্রেন।
রুশ বাহিনীর হাতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির মৃত্যু হলেও ইউক্রেনে সরকার থেমে থাকবে না। কোনো না কোনোভাবে সচল থাকবে। সিবিএস নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটি জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিন্েকন। তিনি বলেছেন, শেষ পর্যন্ত রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দখল নিয়ে নেয় তাহলে জেলেনস্কিকে অন্যদেশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া হবে। এসব বিষয় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ন্যাটোভুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর সাথে।
ব্লিন্েকন তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ইউক্রেন নিয়ে তার যেসব পরিকল্পনার কথা বলেছেন, তাতে করে স্পষ্ট ধারনা মেলে মূলত রাশিয়ার মূল প্রতিপক্ষ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনকে সামনে রেখে যুদ্ধের আসল নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন রাজনীতিবিদ, সাবেক কংগ্রেসম্যান রন পল ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে চিহ্নিত করেছেন ‘ন্যাটোর অনাবশ্যক সম্প্রসারণের খেসারত’ হিসেবে। ১৯৮৮ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন।
সম্প্রতি তিনি একটি নিবন্ধে জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ প্রদান প্রসঙ্গে যা লিখেছেন তার কিছু চুম্বকাংশ আমি এখানে তুলে ধরছি। রন পল লিখেছেন- ‘এটি একটি ভয়ংকর আইডিয়া। ২০০৮ সালে আমি এই প্রস্তাব অনুমোদনের ভোটে কংগ্রেসকে ‘না’ জানিয়েছিলাম। আমার এই অবস্থানের ব্যাখ্যায় বলেছিলাম- যে উদ্দেশ্যে ন্যাটোর প্রতিষ্ঠা, খোদ সেই উদ্দেশ্যেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে ওয়ারশ জোটের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে। জর্জিয়া ও ইউক্রেনের সামরিক গ্যারান্টার কেন হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে? তাতে কি মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপর চাপ কমবে? সবচেয়ে বড় কথা, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর ছাতার তলায় নিয়ে আসার অর্থ হলো ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলে কোন যুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক যুদ্ধে লড়তে হবে, যেখানে তার জাতীয় স্বার্থ অনুপস্থিত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমার শঙ্কা আজ সত্য প্রমাণিত হলো। রুশ সামরিক কৌশল বিশ্লেষণ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য বোঝার কোনোই দরকার নেই এখন।
বুদ্ধিমানরা এমনিতেই অনুধাবন করবেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ নামক যে লাল দাগটি বর্তমানে পুতিন অতিক্রম করে ফেলেছেন, সেটি নিচক খেয়ালবশত নয়। কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটল, তাও কি অপ্রত্যাশিত ছিল? মার্কিন নীতি নির্ধারকরা কি বলেন? যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দরকার ছিল না ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটানো এবং ইউক্রেন ও জর্জিয়ার মাধ্যমে ন্যাটোর সামরিক শক্তিকে একেবারে মস্কোর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। ওয়াশিংটন কি আরও বেশি নিরাপদ হলো তাতে? বরং আমি বলব, খোদ ন্যাটোর ধারনাটাই একটা ভ্রান্ত আইডিয়া’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনের শরণার্থীদের নিয়ে যতটা উদ্ধিগ্ন এবং তৎপর ততটাই তাদের বিপরীত অবস্থান ফিলিস্তিনে। ফিলিস্তিনের নিরীহ জনসাধারণের উপর যুগ যুগ ধরে ইসরাইলি বর্বরতা তাদের চোখে পড়ে না। মানবাধিকার যেন সেখানে লঙ্ঘন হয় না। মিয়ানমার নির্যাতন- নিপীড়ন চালিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্টীকে নির্মূলের যে মিশনে নেমেছে তাও তাদের চৈতন্যে নাড়া দেয় না। বাংলাদেশের ঘাড়ে যে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা তা নিয়েও তাদের উদ্ধেগ-উৎকণ্ঠার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যায় না। জাতিসংঘ পশ্চিমাদের সাথে তাল মিলিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যত দ্রুত নিন্দা প্রস্তাব এবং নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে তার সামান্যতম কিছুই করেনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ এ পর্যন্ত কোন নিষেধাজ্ঞা বা নিন্দা প্রস্তাব আনতে পেরেছে কি? ইসরাইল বরং ঘোষণা দিয়েছে, ইউক্রেনের সকল ইহুদীকে তারা আশ্রয় দেবে, ফিলিস্তিনি জনবসতি উচ্ছেদ করে সেখানে ইউক্রেনের ইহুদীদের পুনর্বাসন করা হবে। তাদের ইসরাইলের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। উদ্দেশ্য, ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার চেয়ে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ানো। ইতিমধ্যে দুটি ফ্লাইটে ইউক্রেনের ৭০০ ইহুদী নাগরিক ইসরাইল পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে এদের বসতি গড়ে দিয়ে নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে ইসরাইল, যেন পর্যায়ক্রমে ইউক্রেনের সব ইহুদি ইসরাইল যেতে আগ্রহী হয়।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এখানে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বজায় রাখার অভিযোগ করেছে। তারা লিখেছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় যতটা উৎসাহের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তৎপর, ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ততটাই নিরুৎসাহী থেকেছে।
আরব রাষ্ট্রসমূহও ইসরাইলের বিরুদ্ধে সবসময় বোবা হয়ে থেকেছে। এখন অনেক আরব রাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের দহরম-মহরম বেড়েছে। মার খেতে খেতে পিট দেয়ালে ঠেকে গেলেও আরবদের সম্মিলিত কোনো অবস্থান নেই। ৮০’ দশকে কর্মসূত্রে আমি জর্ডানে থাকাকালে আমার কলিগদের মধ্যে অনেক ফিলিস্থিনি ও মালয়েশিয়ান চায়নিজ ছিলেন। একদিন আলাপকালে মালয়েশিয়ান এক কলিগ (মি. চেঙ) আরবদের ক্রমাগত মার খেয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘অল আরব আর ন্যাটো’। ন্যাটো বলতে তার ব্যাখ্যা ছিল এ রকম ‘নট অ্যাকশন, টকিং অনলি’। বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক না হলেও বললাম এ কারণে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ১০ লাখেরও বেশি ইহুদী নাগরিকের নতুন বসতি স্থাপনে ইসরাইলের ঘোষণায় এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া আরব দেশসমূহ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা ব্যক্ত করেনি। বরং যুদ্ধবাজ জায়নবাদী ইসরাইল এখন ইসরাইলে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ আওয়াজ তুলেছে। আরব ভূখণ্ড অবৈধভাবে দখলদার এই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট মস্কো উড়ে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠক করে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে দূতিয়ালি করেছেন। ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট আইজাক হেরজগ তুরস্ক সফর করে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে বৈঠক করেছেন।
এ লেখা যখন লিখছি তখন তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখান থেকেও কিছু সুখবরের প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কোনো জোরাজোরি করবেন না। এমন কি রুশপন্থী দোনস্ক ও লুহানস্ক নিয়েও সমঝোতার মনোভাব তিনি ব্যক্ত করেছেন। কারণ তিনি এরমধ্যেই বুঝে গেছেন, ন্যাটো তার সামনে যে মূলা ঝুলিয়েছিল তার নাগাল তিনি পাবেন না। তাকে বিপদে ঠেলে দিয়ে ন্যাটো এখন তার পাশে নেই। বিশ্ববাসী এখন যুদ্ধ চায় না। জেলনস্কির বোধোদয়ে ‘সূড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর রেখা’ দেখার প্রত্যাশাটুকু করা যায় কি?
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক











