রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?

ছাবেরা শারমিন | শনিবার , ১২ মার্চ, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘আপাতত রাশিয়ায় এসেছি-না এলে এ জন্মের তীর্থ দর্শন অসমাপ্ত থাকত’। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূ-খণ্ড পৃথিবীর মোট স্থলভাগের এক অষ্টমাংশ দখল করে আছে। এই দেশের আয়তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের দ্বিগুণ। আর বাংলাদেশে থেকে ১১৬ গুণ বড়। এই বিশাল ভূ-খণ্ডের চার-পঞ্চমাংশের মতো এশিয়াতে অবস্থিত। সুতরাং সোভিয়েত ইউরোপ ও এশিয়া উভয়েরই। পৃথিবীর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এরূপ অদ্ভুত দৃষ্টান্ত আর দেখা যায় না। আবার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যেও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণ অসাধারণ। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের মতো জনগণের জীবনও বৈচিত্র্যময়। জনসংখ্যায় চীন ও ভারতের পরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থান। উদ্ভবগত, ভাষাগত, আচার ব্যবহারগত বৈচিত্র্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ অনন্যসাধারণ। জনসংখ্যার অর্ধেক রাশিয়ান এবং এক পঞ্চমাংশ ইউক্রেনীয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রায় ১৮০টি বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত। বর্তমান সোভিয়েত রাষ্ট্রের ইতিহাস দীর্ঘদিনের নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেও রুশ সাম্রাজ্যের প্রতাপ এবং জারের স্বৈরাচারী শাসনক্ষমতা অব্যাহত ছিল। জারের শাসনাধীন দেশ ছিল কৃষিপ্রধান, কিন্তু সাধারণ কৃষকগণ ছিল অত্যাচারিত, নিপীড়িত এবং শোষিত। এই অবস্থার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে প্রতিবাদ ধূমায়িত হতে থাকে এবং রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে। দলগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল কার্ল মার্ক্সের মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত সামাজিক গণতন্ত্রী দল। পরে এই দল বলশেভিক ও মেনশেভিক দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বলশেভিক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন লেনিন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অত্যাচারী জার শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান শুরু হয়। সকলের মুখে ‘জারের পতন হোক’, ‘খাদ্য ও শান্তি চাই’ ইত্যাদি ধ্বনিত হতে লাগল। অবস্থা চরমে পৌঁছলে ১৯১৭ সালে জারের শাসনের অবসান ঘটে। এটিই মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নামে পরিচিত। ১৯২২ সালে ইউক্রেন, রাশিয়া, ককেশিয়া এবং রুশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সংবিধান অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি অখণ্ড বহুজাতি সমন্বয়ে সমাজতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র। ১৫টি প্রজাতন্ত্র নিয়ে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়।
সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় রিপাবলিক, ইউক্রেন, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, জর্জিয়া, আজারবাইজান, লিথুয়ানিয়া, মলডেভিয়া, লাটভিয়া, কিরগিজ, তাজাকিস্তান, আর্মেনিয়া, তুর্কমেন, এস্তোনিয়া। ১৯২৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোলান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বদলে যাওয়া বিশ্ব রাজনীতিতে শুরু হয় ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ। ঠাণ্ডাযুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধের ফল হিসেবে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউনিয়নের ধনতান্ত্রিক দেশ নিয়ে গড়ে উঠে সামরিক জোট ‘ন্যাটো’। অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশের জোট ‘ওয়ারশাও’। শক্তি সাম্যের নীতির উপর গড়ে উঠেছিল এই সামরিক জোট। ১৯৪৯ সালে ১২টি রাষ্ট্র নিয়ে ন্যাটো জোট গঠিত হয়। ব্রিটেন, ইটালি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, পর্তুগাল, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা। বর্তমানের ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০। ‘ন্যাটো’র প্রতিপক্ষ হিসেবে ১৯৫৫ সালে সমাজতান্ত্রিক ৮টি রাষ্ট্র নিয়ে সোভিয়েট ইউনিয়ন ‘ওয়ারশাও’ জোট গঠন করে। এই জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো- সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাংগেরি, পূর্ব জার্মানি, আলবেনিয়া, রোমানিয়া ও চেকোস্লাভাকিয়া। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে ‘ওয়ারশাও’ জোট বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের পথ সুগম হয়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে ‘ন্যাটো’ নিজেদের জোটে আনতে সক্ষম হয়।
ইউক্রেন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিবেশি রাষ্ট্র। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১ সেপ্টেম্বর ১ গণভোটে ইউক্রেনের জনগণ সমর্থন দেয়। ইউক্রেনের এই ঘোষণা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৬টার কিছুক্ষণ আগে ইউক্রেনের সাধারণ জীবনযাপন হঠাৎ হতচকিত হয়ে উঠে বিস্ফোরণের আওয়াজে। কারণ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দিলে সামরিক অভিযানে প্রস্তুত থাকা রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের দক্ষিণ অঞ্চলে অভিযান শুরু করে। অতঃপর বর্তমান সময়ের টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড হলো রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যু। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মস্কোর সাথে সবধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ইউক্রেন। কিন্তু ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ কিভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নিলো তা জানতে আমাদের পিছনে যেতে হবে। এর সূত্রপাত ঘটে ২০১৪ সালে যখন রাশিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেনে প্রথম প্রবেশ করে। তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বড় একটি অংশ দখলে নেয়। ঠিক তখনি রুশ সৈন্যদের সাথে ইউক্রেনের সৈন্যদের বিবাদের পঠভূমি রচিত হতে থাকে। যুদ্ধ বন্ধে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তি হলেও লড়াই থামানো যায়নি। আর এ কারণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলছে ঐ অঞ্চলে তিনি তথাকথিত শান্তিরক্ষী পাঠাচ্ছে। বেলারুশের রাজধানী মেনস্কে ২০১৫ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যেখানে প্রধান শর্ত ছিল ওই অঞ্চল থেকে সামরিক স্থাপনা, সামরিক সরঞ্জাম, ভাড়াটে সেনাদের সরিয়ে নিতে হবে। এছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়। অঞ্চলগুলোতে নিজস্ব পুলিশ বাহিনী ও স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা নিয়োগের কথা বলা হয়। তবে চুক্তির কোনো শর্তই বাস্তবায়ন করেনি কিয়েভ (ইউক্রেনের রাজধানী)। ইউক্রেনের ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে চাওয়ার ইচ্ছাও যুদ্ধের আরেকটি কারণ। এ বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছিল রাশিয়া। রাশিয়ার দাবি ইউক্রেন ন্যাটো তে যোগ দেবে না। ন্যাটো পশ্চিমা দেশগুলোর একটি সামরিক জোট। ইউক্রেন পশ্চিমা দেশগুলোর হাতের পুতুল এবং কখনোই পশ্চিমা দেশের প্রকৃত রাষ্ট ছিল না। ইউক্রেন দেশ হিসেবে স্বীকৃতির পরও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি দেশ হিসেবে রাশিয়ার সাথে দেশটির গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে যেখানে রুশ ভাষার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। ইউক্রেন হলো রাশিয়ার আদি রুশ ভূমি।
এমতাবস্থায় দু দেশের মধ্যে সম্পর্ক সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দাবি- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাশিয়া বড় কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন ন্যাটো’র এক ইঞ্চি ভূমিও ছাড় দেওয়া হবে না। তাই বিশ্ববাসী আশংকা করছে এই সমস্যা কি বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে?

লেখক : সহকারী অধ্যাপক
বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্ম অনুভূতির অর্থহীন মেঘ ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীন
পরবর্তী নিবন্ধসুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর রেখা!