সুস্থ শিশুতে মা-বাবার মুখে হাসি

আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার চিকিৎসা হয় প্রতিদিন আসে ৮০-১০০ জন শিশু

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

চাঁদপুরের শাহরাস্তি এলাকার রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন। স্ত্রী মায়মুনা মানুষের বাসায় কাজ করেন। বিয়ের বছর তিনেক পর জন্ম নেয় ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। গায়ের রং উজ্জ্বল। চমৎকার চেহারার শিশুটি বড় হতে থাকে। মানুষের নজর থেকে বাঁচাতে কপালের এক পাশে সবসময় কালো টিপ পরিয়ে রাখতেন মায়মুনা।

দিন যায়। কিন্তু শিশুটি অন্য দশটি শিশুর মতো খেলে না। ‘মা’ বলেও ডাকে না। সময় গড়াতে থাকে। আজ নয় কাল ‘মা’ ডাক শুনবেন, এমন আশা নিয়ে অপেক্ষা করেন মায়মুনা। কিন্তু বয়স বাড়তে থাকে। চার বছর বয়সেও শিশুটি ‘মা’ ডাকে না। ডাকে না ‘বাবা’ বা ‘দাদা’। সমবয়সী শিশুরা কথা বলছে। কিন্তু আনোয়ার হোসেনের সন্তান কথা বলে না। খেলাধুলা করে নিজের মতো। খাওয়া দাওয়া করে, দৌড়ায়, হাসে-কাঁদে। কিন্তু কথা বলে না।

আনোয়ার হোসেনের কপালে ভাঁজ পড়ে। চেহারা কালো হয়ে যায় মায়ের। প্রতিবেশীরা নানা কথা বলেন। বুদ্ধি পরামর্শও দেন। কত জায়গায় যে বাচ্চাকে ঝাড়ফুঁক করানো হয়েছে! কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। সীমিত সামর্থ্যে ডাক্তার বদ্যি দেখিয়েছেন। আয়ের বেশিরভাগ টাকা সন্তানের পেছনে খরচ করেছেন। যদি একবার ‘মা’ ডাক শোনা যায়, শোনা যদি যায় ‘বাবা’! কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিল না।

সেই সময় আনোয়ার হোসেন আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের খবর পান। চাঁদপুর থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। সন্তানকে নিয়ে যান বিকাশ কেন্দ্রে। কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর ডা. মাহমুদ এ চৌধুরী আরজুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নিজেদের কষ্টের কথা বুঝিয়ে বলেন।
ডা. আরজু শিশুটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। শুরু করেন চিকিৎসা। প্রথমে স্পিচথেরাপি, ক্রমান্বয়ে অকুপেনশনাল থেরাপি এবং সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিশুটিকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলেন। মাস কয়েক সময় লাগলেও শিশুটি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বাবাকে ডাকে, মাকে শাসায়, কান্না করে, করে খেলাধুলা। একেবার সুস্থ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে শিশুটির বাবা-মা শিশু বিকাশ কেন্দ্রে নিজেদের আবেগ প্রকাশ করে।

এই ধরনের গল্প একটি নয়, শত শত। প্রায় প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে গড়ে আশি থেকে একশটি শিশুকে চিকিৎসার জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্রে আনা হয়। কেবল অটিজম নয়, ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার চিকিৎসা চলে শিশু বিকাশ কেন্দ্রে।

শুধু চট্টগ্রাম নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রামের ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কঙবাজারসহ দূর দূরান্তের অনেক অসহায় পিতা-মাতার ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র। এমনকি ঢাকা থেকেও অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে আসেন এখানে। শুধু অটিজম নয়, চোখের, কানের প্রতিবন্ধিতার পাশাপাশি বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, কথা বলতে না পারাসহ সরকার স্বীকৃত ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার সবগুলোরই চিকিৎসা চলে কেন্দ্রটিতে।

১৯৯৮ সালে ছোট একটি কক্ষে শুরু হওয়া অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে গত ২৪ বছরে প্রায় ৫ লাখ শিশুর চিকিৎসা করা হয়েছে। এখানে চিকিৎসা নেয়া শত শত শিশু স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। কেন্দ্রে অধ্যাপক রয়েছেন ৪ জন, মেডিকেল অফিসার ৬ জন। এছাড়া সাইকোলজিস্ট, থেরাপিস্ট, পুষ্টিবিদ মিলে আরো ১০/১২ জনের একটি টিম কাজ করছে।

শিশু বিকাশ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদ এ চৌধুরী আরজু আজাদীকে বলেন, স্বল্প খরচে আমরা এখানে সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার চিকিৎসা করে থাকি। সময়মতো শিশুটিকে আমাদের কাছে নিয়ে আসলে অধিকাংশ প্রতিবন্ধিতা জয় করে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। তিনি বলেন, কথা না বলা, বুদ্ধির বিকাশ না হওয়া, চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক না হওয়া, কানে না শোনাসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং থেরাপিস্ট আমাদের রয়েছে, যা দেশের আর কোথাও নেই। একই ছাদের নিচে শিশু বিকাশের সমন্বিত চিকিৎসা এই কেন্দ্রটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের জেনারেল সেক্রেটারি রেজাউল করিম আজাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সেন্টারটিকে সমৃদ্ধ করতে তিনি যেভাবে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তার তুলনা হয় না। রাউজানে ৫ একর জায়গায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাউজানের মাননীয় এমপির বদান্যতায় সেন্টারটি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে। এটি প্রতিষ্ঠা হলে প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আরো বড় পরিসরে কাজ করা সম্ভব হবে।

কেন্দ্রের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ধনঞ্জয় দাশ আজাদীকে বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসায় সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সময়মতো শিশুটির চিকিৎসা শুরু করা গেলে অনেক কঠিন বিষয়ও সহজ হয়ে যায়। তাই বাচ্চার শরীর, বুদ্ধি, কথা, চাহনি কিংবা শোনায় কোনো ধরনের সমস্যা দেখলে সাথে সাথে তাকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি।

কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক ডা. ওয়াহিদা আক্তার বলেন, প্রতিদিন প্রচুর শিশু কেন্দ্রটিতে চিকিৎসার জন্য আসে। বর্তমানে যেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে তাতে স্থান সংকুলান করা কঠিন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশু বিকাশ কেন্দ্রটির কার্যক্রম আরো বড় পরিসরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে।

কেন্দ্রের রেজিস্ট্রার ডা. রেহেনা আহমেদ বলেন, প্রতিদিন নতুন নতুন রোগী নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে সকাল থেকে কেন্দ্রটিতে ভিড় করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে চন্দনপুরা একাদশের জয়
পরবর্তী নিবন্ধসান্তোসে পেলেকে লাখো মানুষের শেষ বিদায়