সুধীরলাল চক্রবর্তী (১৯১৬–১৯৫২)। বাংলা ভাষার সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী। সুধীরলাল চক্রবর্তীর জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি কৈশোরে কলকাতায় এসে তৎকালীন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি সুর রচনাতেও তার যথেষ্ট উৎসাহ ছিলো। সেখানে তিনি পাঁচ বছর তালিম নেন। কলকাতায় এসে সুধীরলাল হ্যারিসন রোডে গিরিজাশঙ্করের বাড়িতে থেকে তালিম নেওয়া শুরু করেন। রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, মৈজুদ্দিন খান, খলিফা বদল খান প্রমুখের তালিমে সমৃদ্ধ গিরিজাশঙ্করের নিবিড় প্রশিক্ষণে সুধীরলাল খেয়াল–ঠুংরি–ভজন গানে দ্রুত পারদর্শী হয়ে উঠলেন। শিষ্যের নৈপুণ্যে গুরুও খুব খুশি। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক, সঙ্গীতরসিক সাগরময় ঘোষ মাঝে–মাঝে গান শুনতে আসতেন গিরিজাশঙ্করের বাড়ি। স্নেহভাজন সুধীরলালকে বিভিন্ন আসরেও নিয়ে যেতেন গিরিজাশঙ্কর। ঘরোয়া আসরে অংশগ্রহণের সঙ্গে–সঙ্গে রেডিওতেও গাইতে শুরু করেন সুধীরলাল। ইলাহাবাদ, অল বেঙ্গল বিভিন্ন সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের পরিচয় দিলেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে, ঢাকা বেতারকেন্দ্রে সঙ্গীত–প্রযোজকের চাকরি নেন। আবার ফিরলেন ১৯৪৫–এ, কলকাতা বেতার–কেন্দ্রের সঙ্গীত–প্রযোজক হয়ে। তত দিনে তাঁর সঙ্গীতজীবন বিস্তৃত হয়েছে শিল্পী ও প্রশিক্ষক হিসেবে। তিনি আধুনিক বাংলা গান, রাগপ্রধান, গজল, ঠুমরী প্রভৃতি গানে পারদর্শী এবং একজন সুদক্ষ সুরকার ছিলেন। শিল্পী কবীর সুমনের মতে ‘সূক্ষ্ম অলংকারসমৃদ্ধ আধুনিক সুর রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম ও হিমাংশু দত্তর পর তিনিই শেষ সম্রাট।’ ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের বুকে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার, মাকে মনে পড়ে’ গানটিকে অমর করেছিলেন তিনি। সূক্ষ্ম অলঙ্করণ সহজে ফুটত তাঁর স্বরময় কণ্ঠে যেমন ক্ষিপ্রগতির ছুটতান। সুরে মেলোডিকে প্রাধান্য দিয়েই খেয়াল–ঠুংরি–কাওয়ালির অঙ্গ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কোথাও কাব্যগীতির মেজাজ নষ্ট হয়নি।
তাঁরই সুরে গেয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন ঢাকার ছাত্রী উৎপলা সেন (‘এক হাতে মোর পূজার থালা’, ১৯৪৪), ছাত্র শ্যামল মিত্র (‘স্মৃতি তুমি বেদনার’, ১৯৫২)। শ্যামলের প্রথম রেকর্ডও তাঁর সুরে ১৯৫১–তে, ‘শোনো শোনো ওগো’ এবং ‘বন্ধু গো জানি’। তাঁরই আবেগমথিত সুরে গীতা রায়ের (দত্ত) কণ্ঠে মূর্ত হয় ‘বৃন্দাবনে শ্যাম নাই’। তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।