সাহিত্যিক মনিরউদ্দীন ইউসুফ

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সামসুন নাহার আনোয়ার | শুক্রবার , ৪ মার্চ, ২০২২ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

এক ফাল্গুনে জন্মেছিলেন প্রস্থানও আরেক ফাল্গুনে (১৯১৯-১৯৮৭)। প্রধানত তিনি একজন কবি। বিচরণ তাঁর সাহিত্যের সব অঙ্গনে। কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, জীবনচরিত, নাটক, আত্মজীবনীসহ অনুবাদ সাহিত্যেও ছিল তাঁর অসামান্য অবদান। সৃষ্টিশীল এ মানুষটি হলেন বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক মনিরউদ্দীন ইউসুফ।
১৯১৯ সালের ১ ফাল্গুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন নানাবাড়ি ময়মনসিংহ গীতিকার লীলাভূমি কিশোরগঞ্জের জাওয়ার গ্রামে। তাঁর পৈতৃক নিবাসও কিশোরগঞ্জের বৌলাই এ।
কিংবদন্তী আছে মনিরউদ্দীন ইউসুফের একাদশতম পূর্বপুরুষ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আদেশক্রমে কিশোরগঞ্জের বৌলাই অঞ্চলের জায়গির প্রাপ্ত হন। তিনি এই জমিদারির সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নানা আবদুল হেকিম খান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। তাঁর নানা আবদুল হেকিম খান চৌধুরী ছিলেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাস করা ডিসটিংগুইশড গ্র্যাজুয়েট।
মনির উদ্দীন ইউসুফ ছিলেন মেধাবী। দেওবন্দ যাবার প্রস্তুতিকালে তিনি করায়ত্ত করেন ‘ইংরেজি, উর্দু, ফারসি ভাষা। ময়মনসিংহ জেলা থেকে লেটারসহ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় এসে ভর্তি হন ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। যা পরে ঢাকা কলেজে পরবর্তিত হয়। পরবর্তীতে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অনার্স কোর্সে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করতেন ড: মোহাম্মদ শহীদুল্লা, মোহিত লাল মজুমদার, গনেস বসু, আশুতোষ ভট্টাচার্য, ড. এনামুল হক প্রমুখ।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ তাঁর লেখনির মাধ্যমে অচিরেই তার শিক্ষকদের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন।
নানামুখী প্রতিভার অধিকারী কবি মনির উদ্দীন ইউসুফ কেবল লেখকই নন, একজন আদর্শ চিন্তাবিদও। তার লেখনি ছিল বৈচিত্রময়। সাহিত্যের সব শাখায় ছিল তাঁর বিচরণ। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপায়ন’। দীর্ঘদিন বিরতির পর একে একে লিখেছেন রাত্রি নয় কলাপী ময়ূর, এক ঝাঁক পায়রা, বেতস পাতায় জলের ধারা। তাঁর প্রবন্ধ পাঠকের কাছে ছিল মূল্যবান। তিনি লিখেছেন ‘আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, নব মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ’ বাংলা সাহিত্যে সূফি প্রভাব, কারবালা একটি সামাজিক ঘূর্ণাবর্ত (ইংরেজি অনুবাদসহ) উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস, পত্রগুচ্ছ, জীবনচরিত, জীবনীগ্রন্থ, আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতাসহ আরো অনেক প্রবন্ধ।
মৌলিক লেখার পাশাপাশি মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনুবাদ কর্মে মনোনিবেশ করেন। উর্দু, ফারসি, ইংরেজি আর বাংলা ভাষায় ছিল তাঁর দখলদারিত্ব। অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি উর্দু আর ফারসি সাহিত্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। পৃথিবীর সাহিত্য ভাণ্ডারে কঠিনতম কাজ হলো অনুবাদ। শুধু ভাবানুবাদই নয়, বিষয়ের মৌলিকত্বকে অটুট রেখে অনুবাদ হবে সহজ, বোধগম্য।
মনির উদ্দীন ইউসুফ অনুবাদ করেছেন ফারসি সাহিত্যের বিশ্ব বিশ্রুত গ্রন্থ ‘রুমীর মসনবী’। মসনবীর মূল রচয়িতা মৌলানা জালালুদ্দীন রুমী। মৌলানা রুমীর ‘মসনবী’ ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর ফারসি সাহিত্যের ‘এক মহাবৈপ্লবিক গ্রন্থ। সে সময় মুসলিম জাহানের প্রায়াংশ ধর্মের ক্ষেত্রে আচার নির্ভর আর গোঁড়ামিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। মৌলানা রুমীর ‘মসনবী’ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক কঠিন বিদ্রোহ। ‘রুমীর মসনবী’ অনুবাদ শেষ হলে তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড: এনামুল হক ছাত্রের পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে ‘মসনবীর’ ভূমিকা লিখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অনূদিত ‘রুমীর মসনবী’ গ্রন্থে যা আমরা দেখেছি।
অনুবাদ সাহিত্যে মনিরউদ্দীন ইউসুফের সাহিত্য জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
তিনি অনুবাদ করেছেন উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি ইকবালের কবিতা। যা ‘ইকবালের কাব্য সঞ্চায়ন’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। আরো অনুবাদ করেছেন ‘দেওয়ান-ই-গালিব’ ‘হাফিজের গজল সমগ্র’ অনুবাদ করেছেন ফারসি সাহিত্যের মহাকাব্য ‘শাহনামা’। ‘শাহনামা’ বাংলা একাডেমি থেকে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। সময় লেগেছিল সতেরো বছর। ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। কিস্তিতে কিস্তিতে জমা দিতে থাকেন বছরের পর বছর। শেষ কিস্তি জমা দেন ১৯৮১ সালে।
মনির উদ্দীন ইউসুফ বিভিন্ন ভাষার মুক্তো মানিকগুলোকে এনে অনুবাদের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। যার ফলে বাংলা ভাষাভাষীদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে ‘শাহনামার’ মত মহাকাব্য পড়ার। তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পেয়েছেন ‘একুশে পদক’।
তিনি সৃষ্টিশীল জ্ঞানানুরাগী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। মনির উদ্দীন ইউসুফের জন্মশত বর্ষে আমাদের অসীম শ্রদ্ধা রইল।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ-চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসাইদুল ইসলাম