সাম্যের পথে হোক পথচলা

জেসমীন জেসী | সোমবার , ৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

পরিবর্তনশীলতা সমাজের এক চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। যুগে যুগে সমাজে বস্তগত বিষয়ের, অবস্তুগত বিশ্বাসের সর্বক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্তন আসবে। তবে পরিবর্তনটা কোনদিকে এগুচ্ছে তার ওপর সমাজ তথা রাষ্ট্রের উন্নতি, ভালো- মন্দ নির্ভর করে।এই পরিবর্তন কি ইতিবাচকতায় মোড়ানো না কি নেতিবাচকতায় আচ্ছন্ন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
এবার আসা যাক আমার লেখার মূল বিষয়ে। ‘নারী স্বাধীনতা বনাম নারীত্বের অহমিকা’। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন :
‘সে যুগ হয়েছে বাসি / যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো, নারীরা আছিল দাসী। বেদনার যুগ,মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি/ কেহ রহিবে না বন্দী, তবে এর পরযুগে/ আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে। যুগের ধর্ম এই/ পীড়ন করিলে সে-পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।’
নারী মা, বোন, মেয়ে, খালা, ফুফু ু সবাই আপনজন। সেই বঙ্কিমযুগ, রবীন্দ্রযুগ, শরৎযুগ কিংবা নজরুল যুগ- সকলেরই লেখা পড়লেই তৎকালীন সমাজে নারীর অসহায়ত্ব আর নির্যাতিত হওয়ার রূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুগে যুগে নারীরা পুরুষ বা নারী দ্বারা নিষ্পেষিত হয়ে আসছে। নারীর সমগ্র চিন্তাজুড়ে স্বামী-সংসার আর সৃষ্টিকর্তার দেয়া হাত শুধু গৃহকর্ম, মস্তিষ্ক শুধু সংসার ধর্ম আর মুখটা কেবল প্রেমবাণী উচ্চারণের জন্য। সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা, প্রতিভার বিকাশের কোন সুযোগ বা ক্ষেত্র তাদের জন্য কোনকালে ছিল না।
সন্তান উৎপাদন করা, লালন-পালন করাই নারীর অন্যতম মুখ্যকাজ। তবে সন্তানের সমস্ত খারাপ বা অপ্রতাশিত আচরণ বা কাজের জন্য ভর্ৎসনা পাওয়ার ক্ষেত্র- পাত্রও নারী। নয়মাসের অধিক সময় জুড়ে একজন নারী তার দেহে অবর্ণনীয় শারীরিক প্রতিকূলতা সহ্য করে যে সন্তান জন্ম দেয় তার নাম পরিচয়টিও পুরুষের দখলে। সৃষ্টিকর্তা একজন পুরুষকে যেমন জ্ঞান, প্রতিভা দিয়ে জগতে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি একজন নারীকেও সমভাবে সৃষ্টি করেছেন। উপরওয়ালা তো তার এই দুই সৃষ্টিকর্মে কোন বৈষম্য রাখেন নি। সবধরনের বৈষম্য আসলো মূলত সমাজ থেকেই। নারীদের সমস্ত জীবন অন্যের অধীনে থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রথমে মা- বাবা,তারপর স্বামী, শ্বশুর- শাশুড়ি আর শেষ বয়সে পুত্র-পুত্রবধূর দ্বারা। এসবের নেপথ্যে অনেক কারণও কাজ করে থাকে। পরিবারের মানসিকতা যেমন-কন্যা সন্তান হলে অবহেলা, পুত্র সন্তানের কামনা (যেখানে কারণ হিসেবে কাজ করেছে বংশরক্ষা, শেষ বয়সের আহার-নিদ্রার ভরসা ইত্যাদি ইত্যাদি)। তাই পরিবার থেকেই এই বঞ্চনা শুরু হয় নারীদের। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা, জন্মের পর থেকেই বিয়ের জন্য শারীরিক, মানসিকভাবে প্রস্ততকরণের কাজ শুরু হয়ে যায়। গৃহকর্মে পারদর্শী করে তোলা, সেলাই কাজে সুনিপুণতা, কোন কোন ক্ষেত্রে গান শেখানো ইত্যাদি। আবার সেই সাথে যুক্ত ছিল লম্বা চুল রাখা, আস্তে কথা বলা, জোরে না হাসা, ধীরে হাঁটা চলা, গায়ের রঙ ফর্সা করার জন্য নানান সামগ্রী ব্যবহারের চর্চা করা। মোট কথা কানের কাছে একই কথা বাজিয়ে চলে, শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে, সেখানে কী করবে? এটা পার না, ওটা পার না, এভাবে হেঁটোনা, ওভাবে হাঁটো ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের কাছে তো আছেই, সাথে যুক্ত হয় পাড়া প্রতিবেশিদের কাছেও লক্ষী বউ কিনা তার পরীক্ষা দেয়ার বিড়ম্বনা। এসব পরীক্ষার ধরণ-ধারণ সম্পর্কে লিখে শেষ করাও যাবে না।
তাই সবসময় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিপক্ষে নারীদের সোচ্চার হওয়া আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। নারী পুরুষ সমতার বিষয়টা খুব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নারী- পুরুষ সমান অধিকারের শ্লোগানে মুখরিতও হল। কবি শরবিন্দু কর্মকার ভাষায়, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাই পুরুষকে বড় করে, জেনে রেখো সেই পুরুষকে নারী…. গর্ভে ধারণ করে’। এসব বাণী ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে শুরু করলো। নারীসমাজে ব্যাপক পরিবর্তন এলো। কন্যা সন্তান জন্মদানের জন্য যে নারী দায়ী নয়, সেই অজুহাতে পুরুষের একাধিক বিয়ের প্রথাও বনধ হল সমাজে। মীনা কার্টুনের মত এখন ডিম কিংবা আমও দুভাগে ভাগ করার জন্য মিঠুর (টিয়া পাখি) মত মানসিকতার ধারণ করতে পেরেছে সমাজের মানুষজন। বর্তমানে পরিবার, সমাজ বুঝতে পেরেছে নারীকে বাদ দিয়ে, অবহেলা- বঞ্চনা করে একটা সমাজ তথা রাষ্ট্র সামনে এগুতে পারে না।
নারীরাও বুঝতে পেরেছে পরনির্ভরশীলতায় ডুবে থাকলে নারীর মুক্তি নেই। তাই মুখ বুজে সহ্য করার দিনও শেষ হল। নারী হল শিক্ষিত, কর্মজীবী, সমাজসেবী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনায়কও বটে। সমাজ – সংসারকে সুন্দর করে তুলতে হলে অবশ্যই নর- নারীর উভয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কবি নজরুলের কবিতার মর্মার্থ থেকেই বোঝা যায় যে, অন্যকে অত্যাচার, নির্যাতন করলে সেই অত্যাচারের অনলের শিখাতে তাকেও জ্বলে পুড়ে অত্যাচারিত হতে হবে। পীড়ন করলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে। পুরুষের রচিত কারাগারে পুরুষকেই বন্দী হয়ে ভুগতে হবে, নিতে হবে বন্দীত্বের কষ্টের স্বাদ। তাই সাম্যের বড় প্রয়োজন ছিল সমাজে। ‘মহাকাল আমার পদতলে/ শায়িত চিরকাল/আমি ছাড়া এ জগত- সংসার সবই হবে অচল’ ( কবি শরবিন্দু কর্মকার)।
নারীদের এই মন্ত্র হলো জেগে ওঠার মন্ত্র। শিক্ষা-দীক্ষায়, অধিকারে সচেতন হওয়ার মন্ত্র। নারীবাদী, নারী-স্বাধীনতার মন্ত্র হলো সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার, সম্মান, মর্যাদার জন্য কিন্তু তা অহমিকা বা আত্মগরিমা প্রকাশের জন্য নয়। অহংবোধে বলীয়ান হয়ে পুরুষকে চপেটাঘাত করতে নয়।
আজ পুরুষ সমাজে অনেকেই অসহায় হয়ে পড়ছে। নারীর অত্যাধিক চাহিদা, অসৌজন্যমূলক আচরণ, অতি বিলাসিতা, সর্বোপরি দাপুটে মনোভাব অর্থাৎ আমি কম কীসে, আমার কী নেই, এই ধরনের অহংবোধে নিমজ্জিত হয়ে দিন দিন কেমন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে আর পুরুষকে করে দিচ্ছে কোণঠাসা। নারীর শারীরিক, মানসিক, আর্থিক চাহিদায় চাপে পিষ্ট হয়ে স্নায়ুবিক চাপ নিয়ে পুরুষ এখন প্রায় দিশেহারা। গাড়ি, বাড়ি, শাড়ি, গয়না প্রভৃতির লাগামহীন চাই চাই মানসিকতা পুরুষের জীবনটাকে করে তুলছে বিষময়। আগে শুনতাম মেয়ের বাবা- মা চিন্তায় থাকতেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কেমন হবে? সেখানে সে টিকে থাকতে পারবে কি না? আর এখন শুনি ছেলের মা – বাবারা চিন্তিত ছেলেটাকে বিয়ে দিলে কেমন মেয়ে কপালে জুটে! ভাবনার এই এক ব্যাপক পরিবর্তন! পুরুষতান্ত্রিকতার পোশাক ছেড়ে কি সমাজ নারীতান্ত্রিকতার বেশ পরতে চলেছে তবে? সমাজের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, পারস্পরিক সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ বলতে অবশিষ্ট আর থাকছে না। ক্রমেই বিলীনের দৌড়ে। ‘আমরা সবাই রাজা’ টাইপের মনোভাব নিয়ে চলছে। তাই পরিবারে কলহ, বিবাদ, ঝগড়াঝাটি, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি নিত্যঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আজকের শিশুরাই তো আগামীর সুন্দর সমাজের কর্ণধার। কিন্তু পরিবার, সমাজ থেকে তারা দেখে শুনে কোন মানসিকতায় বড় হচ্ছে। শ্রদ্ধাবোধ,বচনে- আচরণে শালীনতা এগুলোতো তারা শিখবেই না। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যত সমাজকাঠামো এক ঘুনেধরা রূপ নিয়ে গড়ে ওঠবে। এটা যে আমাদের জন্য কোনভাবেই হিতকর হবে না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নারী- পুরুষ উভয়ের মধ্যে ছোট- বড়, সম্মান- অসম্মানের, ক্ষমতাহীন- ক্ষমতাধর এসব বিষয় না টেনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে সুন্দর সমাজ সৃষ্টি হওয়া দরকার। পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের কল্যাণ নিহিত রয়েছে মূলত সেখানেই। পুরুষ বড় না কি নারী বড় এইসব বিষয় মুখ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, পুরুষতান্ত্রিকতা কিংবা নারীতান্ত্রিকতা কোনটাই কাম্য নয়। সাম্যের পথে হোক পথচলা। পিতা- মাতা, পুত্র- কন্যা, ভাই- বোন… সকলের সমান অংশগ্রহণ, মর্যাদায়, সম্মানে ফুলে ফুলে ভরে উঠুক আমাদের আগামী সমাজের বাগান। তাই লাগাম ধরতে হবে নারীর এই অহিতকর দৌড় নিজেদেরই। আগামী প্রজন্মের জন্য সমাজ হয়ে উঠুক নিরাপদ, সুখের, স্বস্তির আর পরিচ্ছন্ন মানসিকতা চর্চার ক্ষেত্র।
লেখক : শিক্ষক, কবি

পূর্ববর্তী নিবন্ধশুভ হোক পথ চলা
পরবর্তী নিবন্ধউপজেলা হাসপাতালসমূহে চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটের বিপর্যস্ত চিত্র