: একুশের বইমেলা চট্টগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী।
: চট্টগ্রামের বই প্রেমিক মানুষ আনন্দচিত্তে বইমেলা অনুষ্ঠানের সংবাদটি গ্রহণ করেছেন। করোনার কারণে আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত ছিলাম এবং আছি। মনের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এই করোনার মধ্যেও ২৩ মার্চ (পতাকা দিবস) থেকে ১৫ অথবা ১৮ দিন বইমেলা হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এবং সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের সহযোগিতায় কাজ এগুচ্ছে। সাথে রয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, কবি, মুক্তিযোদ্ধা এবং সৃষ্টিশীল মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাসে চেতনায় রয়েছে একুশ এবং স্বাধীনতার দর্শন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র, বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বই মেলার তৃতীয় প্রয়াসের প্রত্যক্ষ নাবিক। একজন সৃজনশীল মানুষের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তিনি মেয়র এর দায়িত্বে এসেছেন। চট্টগ্রামের তৃণমূলের রাজনীতি থেকে তিনি নগর পিতা হয়েছেন এবং স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের দর্শনকে বুকে নিয়ে ছিলেন বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে। দেশ মুক্ত করে ফিরেছেন স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে। তাঁকে সামনে রেখে বই মেলার প্রত্যাশার কথাগুলো বলতে চাইছি। কোন দাবি নয়, কোন অভিযোগ নয় শুধু মনের কথা বলা। আমরা অনেকে অভিযোগ করি বা মেলা পরিচালনায় যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের কড়া কন্ঠে সমালোচনা করি। এই সমালোচনা আমাদের কতোটুকু শিক্ষা দিয়েছে জানি না তবে কারো কারো কাজের আগ্রহ কমে গেছে। ভুলতো হতেই পারে। যারা কাজ করেন তাদেরই ভুল হয়। আর যারা কাজ করেন না তারা কোন ভুল করেন না। তাদের কাজ হচ্ছে সমালোচনা করা। আমার দৃষ্টিতে ভুলটাও কাজের অংশ। সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হয়। সম্মান ও মর্যাদার একটা বিষয় আছে। কথা ও কাজে অন্যের সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট করে নিজের সম্মান বাড়ানো যায় না। ভালো কাজগুলো আমি করেছি আর মন্দগুলো উনি করেছেন এমন ইংগিত বা এমন কথা বলে বই মেলাকে সমালোচনার পর্যায়ে নেওয়া ঠিক হবে না। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো কাজ করার চেষ্টা করেন। তবে ইচ্ছা করে যারা ভুল করেন তাদের নিকট থেকে সাবধান থাকার চেষ্টা করা উচিত। বিগত সময়ের ভুল থেকে মুজিব বর্ষে শিক্ষা আমার আপনার সবার নেওয়া নৈতিকতা। মুজিব শতবর্ষ এই মেলা একুশকে নিয়ে যেমন এগুবে তেমনিতো বাংলা এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার।
এই মেলা সর্বজনীন একথাটার সাথে কিছুটা দ্বিমত করছি বরং বলতে চাইছি প্রগতিশীলদের সর্বজনীন বই মেলা। কে আসবেন কে আসবেন না তাতো নির্ধারণ করবে মেলার বৈশিষ্ট্যের ওপর। নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্ভর করছে আয়োজকদের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের মাপকাঠিতে। তবে মনে রাখতে হবে মেলায় যেন অশুভ শক্তির আবির্ভাব না ঘটে। এই মেলা যদি শুধুই বাণিজ্য মেলার রূপ ধারণ করে তাহলে আশাহত হবে এই চট্টগ্রামের সৃজনশীল মানুষ। যারা লিখছেন, লেখার চেষ্টা করছেন, দু’একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের জন্য স্পেস রাখার চেষ্টা থাকাটা নৈতিকতা যদি গ্রন্থটি প্রগতির ছোঁয়া সমৃদ্ধ হয়। মেলায় মানুষের আগমনকে উৎসাহিত করতে হবে কারণ মেলার প্রাণ হচ্ছে লেখক, পাঠক, ক্রেতা। তাই স্বচ্ছতার মাধ্যমে উদার অঙ্গন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখাটাও জরুরী। অতীত বলছে আমরা কেউ কেউ ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাই। এটা অন্যায় কিছু নয় তবে প্রথমে চট্টগ্রামের সৃষ্টিশীল মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীদের সম্মানের স্থানটিকে নিশ্চিত করাটা প্রয়োজন। এই চট্টগ্রামে অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষ আছেন যাঁরা চট্টগ্রামের মাটিকে বুকে আঁকড়ে রেখেছেন। তাঁরা ঢাকা মুখী হননি চট্টগ্রামের টানে। বিভিন্ন পর্বের আলোচনায় তাঁদের জন্য মর্যাদার আসনটি রাখার চেষ্টা থাকাটা প্রয়োজন মনে করছি। নিজের সুবিধার জন্য অথবা নিজেকে বিশেষ মহলের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা না করে চট্টগ্রামকে তুলে ধরলে মাটির ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। আলোচনার বিষয়বসু্ত নির্ধারণে সব বয়সী মানুষের কথাটা ভাবা জরুরি। একুশের আলোচনাটা যদি একুশ নির্ভর হয় তাহলে শ্রোতারা তথ্য পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনেক আলোচনার মধ্যে চট্টগ্রামের একুশ, একুশের প্রথম কবিতা, কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, দবির আহমদ চৌধুরী, কামাল উদ্দিন আহমদ খান, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, চেমন আরা, নেলী সেনগুপ্তা, ননী ধর, জওশন আরা রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান, এম.এ. আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, কুন্দ প্রভা সেন বা এমন মানুষদের নিয়ে আলোচনাকে সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। এমন কথাগুলো বলার মানুষ চট্টগ্রামে নেই এমন কথা বলা যাবে না। আলোচনার বিষয়কে সহজ করে এপ্রজন্মের সামনে উপস্থাপনটা কিন্তু বই মেলার অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। যাঁরা মেলার বিভিন্ন নীতিনির্ধারণীতে রয়েছেন তাঁদের জ্ঞান এবং মননশীলতার ঘাটতি নেই। আশা করার মতো মানুষ তাঁরা। তবে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা এবং প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থের জন্য বিশেষ স্টল রাখার চেষ্টায় থাকতে হবে।
মেলার সজ্জা, স্টলের সজ্জা অর্থাৎ পুরো মেলার সাজ সজ্জা একই করা যায় কিনা তাও ভাবতে হবে। কারণ প্রতিটি স্টলে বা ভেতরে বাইরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর ছোঁয়া থাকা অথবা রাখা যায় কিনা তাও ভাববার বিষয়। পুরো মেলাকে যদি একই রঙে রাঙানো যায় তাহলে বিশেষ আবহের সৃষ্টি হবে বলে বিশ্বাস। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ঈযরঃঃধমড়হম ঃড় ঃযব ভড়ৎব- অগ্রগামী চট্টগ্রাম। তাই এই মেলার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে একই আদলে রাখতে পারলে তাহলে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর চেতনা সফল হবে এবং অন্যরাও আগামীতে এই ধারণায় এগুতে পারবে। যে অঙ্গণে মেলার আয়োজন হচ্ছে স্থানটির প্রাকৃতিক অবস্থান, ঐতিহাসিক মর্যাদাটা কিন্তু সুন্দর। সে আদলে গত বছর সুন্দর মেলার আয়োজন হয়েছে। এবারও হবে। তবে মৌলিক কিছু উন্নতি প্রয়োজন। বাথরুমগুলোতে পানি, আলোর ব্যবস্থা এবং পাহারা ব্যবস্থার জোরদার করা প্রয়োজন। গাড়ি বা মটর সাইকেল রাখবে স্থান নির্ধারণ করা যায় কিনা ভাবা প্রয়োজন।
যেহেতু মৌলিক প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন সেজন্য তাঁদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার প্রতিটি ক্ষেত্রকে প্রত্যক্ষ তদারকি থাকাটা প্রয়োজন। তা নাহলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারেন কর্মীরা। এজন্য তাদের কষ্ট হতে পারে তারপরও সে কষ্টটা স্বীকার করতেই হবে। চট্টগ্রামের একক বই মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো চট্টগ্রাম আনন্দিত এবং রোমাঞ্চিত। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। নেতিবাচক কথা বলে বা নেতিবাচক সমালোচনা করে মহান কাজের আশা করা যায় না। কারণ মনে রাখতে হবে চট্টগ্রাম ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ। সেই হাবিলদার রজব আলী বিদ্রোহ, মাস্টারদা সূর্যসেনের বিদ্রোহ এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনা এখন ইতিহাসের অংশ। যেমন,
১. একুশের প্রথম কবিতা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকেই লেখা ও কোহিনুর প্রেস থেকে মুদ্রিত।
২. স্বাধীনতার প্রথম কবিতা কাজী জাফরুল ইসলাম চট্টগ্রাম।
৩. ৬ দফার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধু।
৪. স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রস্তাব চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগ এবং চট্টগ্রামের ছেলে স্বপন চৌধুরী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভায় উপস্থাপন।
৫. স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম থেকেই, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে এম.এ. হান্নানের কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৬ মার্চ এবং ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার কন্ঠে। এগুলো চট্টগ্রাম থেকেই।
৬. স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রকাশিত দৈনিক আজাদী এটাও কিন্তু চট্টগ্রাম থেকেই।
ইতিহাসের অনেক উপাত্ত এই চট্টগ্রামে আছে। তাই বইমেলাকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেন আবারো বলা যায় ঈযরঃঃধমড়হম ঃড় ঃযব ভড়ৎব- পুরানো মেয়র, প্রশাসক ও নতুন মেয়র সবাইকে নিয়ে ভাববেন। এই প্রত্যাশা করছি। যাঁরা শ্রম দিচ্ছেন তাদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। প্রতিজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডকে সম্পৃক্ত করলে চট্টগ্রাম নগরের ৬০ লক্ষ মানুষের তথ্য প্রবাহ বেড়ে যাবে। প্রয়োজন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নজরদারী।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।