সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২১ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

: দৈনিক আজাদী’র ক্যাপশন: বৃদ্ধা হলেও তো মা।
: প্রচুর পাঠক (৩০.১২.২০২০) এই ক্যাপশনে মুগ্ধ হয়েছেন। অনেকে চোখের জল ফেলে বলেছেন, এমন ছেলেও তো আছেন। সংবাদটি ছিলো, বাস থেকে নেমে সন্তান মাকে কাঁধে নিয়ে ভাসানচরগামী জাহাজে উঠছেন। ছবি দেখে বুঝা গেলো মা’র বয়স ৭০/৭৫ হবে। এমন মাকে নিয়েই ছেলে মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন। মা বোধ করি তখনও ছেলের পিঠে চড়েই এসেছেন। মাকে বহন করার কষ্ট ছেলে বোধ করেননি। আনন্দ চিত্তেই সন্তান এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন মা এবং সন্তান সত্যিই গৌরবের। চিন্তা করা যায়! ছেলে মুখে মাস্ক পরে হাঁটছেন, মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে করুণা বিধূর অবয়বে মাথায় ঘোমটা জড়িয়ে ছেলের পিঠে নিরাপদ আশ্রয়ে। এমন অসহায় মা-ছেলেকে মায়ানমারের সামরিক সরকার অস্ত্রের মুখে দেশ ছাড়া করেছে। এমন এক ভয়াবহতা আমরা বাঙালিরা দেখেছি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙালি মা-বোনদের হত্যা নির্যাতন করেছে। আগুন দিয়ে জ্বালিয়েছে বাঙালিদের বাড়ি ঘর, স্থাপনা। তখন আমরা প্রায় এককোটি মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম ভারতের বিভিন্ন স্থানে। মায়ানমার সরকারের বর্বরতা এবং পাকিস্তান সামরিক সরকারের বর্বরতা কিন্তু একই। ছবির বৃদ্ধা মাকে দেখে মনে পড়ছে অনেক কথা। আমরা অনেকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিজেদের কাছে রাখতে চাই না, বিরক্তবোধ করি এবং তাদেরকে মনে করি পরিবারে একটা ঝামেলা। এই ঝামেলা মুক্ত হওয়ার জন্য তাঁদের পাঠাতে চায় বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে এই ভাগ্যাহত বাবা মা’র সময় কাটে অনাদর অবহেলায়। যদি কখনো তাঁদের কেউ মারা যায় তাহলেও পরিবারের মানুষরা লাশ নিতেও আসতে চায় না। একশ্রেণির সন্তানদের এই হলো মানসিকতা। মেরুদণ্ডহীন সন্তানরাই এমন অমানবিক আচরণ করে। বিপরীত চিত্র যে নেই তাতো নয়। এমন অনেক সন্তান আছেন যারা বাবা-মাকে প্রতিদিন একনজর না দেখে থাকতে পারেন না। লজ্জার সাথে বলতে হয় যে, এমন সন্তানের সংখ্যা দিন দিন কমছে। মাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার সংবাদও আমরা পত্রিকায় পড়েছি। অনেক সন্তান আছেন যারা একান্ত বাধ্য হয়ে মা-বাবাকে নিজের কাছে রাখছেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের তদারকি করছেন। নিজের স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে যা খাচ্ছেন আবার কাজের বুয়ার সাথে বাবা-মাকে দুর্বল মানের খাওয়া দিচ্ছেন। কাজের বুয়াও কিন্তু মানুষ।
: এমন কেন হচ্ছে…?
: এখন অনেক বাবা-মা সন্তানের গৃহে থাকছেন অনেকটা অনাদর অবহেলায়। বাসার কাজের মানুষের মর্যাদায়। সকালে নাতি নাতনিদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়, বাজার করে আনতে হয়, সময়ে অসময়ে নানান কাজে যেতে হয়। অনেক গৃহবধূ (সবাই নয়) ভাবেন একজন কাজের ছেলেকে রাখতে হলে এবং এমন কাজ করার মানুষকে অন্তত: ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। এর চাইতে নিজের শ্বশুর যদি এ কাজগুলো করে বিনিময়ে তাকে সকালে নাস্তা, দুপুরে ও রাতে খাওয়া দিলেই চলে। আবার বিশ্বাসের ব্যাপার। লোক দেখানো চর্চাও হয়। মানুষের কাছে জোর গলায় বলা যায় যে, শ্বশুর শাশুড়িতো আমাদের কাছেই থাকেন। এমন অনেক সন্তান বা পুত্রবধূ আছেন যারা তাদের শিশু সন্তানদের বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ির সান্নিধ্যে আসতে দেন না। এটা যে কতো কষ্টের তা কি এ প্রজন্মের বাবা-মা হওয়া সন্তানরা বুঝতে পারেন? উচ্চ শিক্ষা নিয়ে অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শিখরে ওঠা সন্তান যদি তার বাবা-মার প্রতি এমন আচরণ করেন তা কি শিক্ষার সাথে মানায়? সন্তানের সাথে একটেবিলে খাওয়ার সুযোগ হয় না, নাতি নাতনির আদর বঞ্চিত, ঘরের এককোণে পড়ে থাকা এক বৃদ্ধ বৃদ্ধার একটি সত্য ঘটনাবলি। গ্রামের স্কুল মাস্টার ছিলেন বাবা আ…। সংসারের খরচ, ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালানোর মতো অর্থ তাঁর ছিলো না। তাই ফজরের আজান পড়ার পূর্বেই ঘুম থেকে ওঠে নামাজ সেরে নিজের জমিতে চলে যেতেন। ঘন্টা দু’য়েক জমিতে কাজ করে ফিরতেন বাড়িতে। গোসল সেরে পানিভাত খেয়ে স্কুলে যেতেন। বিশ্রাম বলেতো কিছু ছিলো না। ভালো ও আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিলো। তাই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের ফাঁকি দিতেন না। বিকেলে বাড়ি ফিরে কিছু সময় স্ত্রীর কাজে সহযোগী হতেন। তারপর মাগরেবের নামাজ সেরে চলে যেতেন ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে। পড়াতেন তাদের। কেউ টাকা দিতেন কেউ দিতেন না। অতি দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীকে এমনিতেই পড়াতেন, তাদের খাতা পত্র কিনে দিতেন। এমন করে তিনি বাড়তি আয় করে, সংসার খরচ বাঁচিয়ে এক ছেলে ও এক মেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছিলো ছেলে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু প্রকৃত মানুষ হয়নি। একমাত্র মেয়ে অন্যজনের ঘরনী, কলেজের শিক্ষক। তার ইচ্ছা হলো বড় ভাইদের বাসায় বাবা-মাকে দেখতে যাবে। সময় করে এসে বাবা-মার দুর্দশা দেখে মেয়েটি চোখের জলে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন এরা কি আমাদের বাবা-মা! অনেকদিন পর নিজের মেয়েকে দেখে বাবা-মা দু:খ ভুলে ছেলে এবং বৌমার প্রশংসা করলেন। তারপর ছেলে এবং বৌমার অনেক অভিনয় হয়েছে। অধ্যাপক মেয়ে যা বুঝার বুঝে গেলেন।
: এমন সন্তান কি আমরা চাই!
: মাত্র ১০ বছরের শিশু তার বাবা-মাকে বলছেন, তোমরা যখন বুড়ো হবে তখন কি তোমরাও দাদুর মতো ঘরে থাকবে, কাজের বুয়ার খাওয়া খাবে? এমন কথা বলে শিশুটি নিজের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। এমন এক দৃশ্যে প্রধান নায়কের ভূমিকায় নেমে এলেন দাদা-দাদি মা। তারা অনেক কষ্টে দরজা খুলে নাতিকে জড়িয়ে ধরে নিজের সন্তানকে শুধু বলেছেন আমার গ্রামটা অনেক সুন্দর। দু’দিন পর খুব ভোরে ছেলে দেখে বাবা-মা ঘরে নেই। তাদের সব কিছু আছে, অসুধ পড়ে রয়েছে, গরম কাপড় আলনায় ঝুলছে, প্লেট, গ্লাস যেমন ছিলো তেমনি আছে। শুধু নেই বাবার ডায়রিটা। এটাই তাঁর পুরো জীবন স্মৃতি। কোথায় গেলেন তারা! বাড়ির দারোয়ান বললেন, তিনিতো খুব ভোরে চলে গেছেন। যাওয়ার সময় আমার হাতে ৫০০ টাকার নোটটি দিয়ে বলেছেন, আমার নাতিটার খবর রেখ। আর কিছুই বলেননি। বার বার পেছনে ফিরে তাকিয়ে চোখের জল মুছে রিকশায় ওঠে বসেছে। ছেলে এদিক ওদিক সব দিকে খুঁজে ক্লান্ত। লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেননি। নিজের বোনকে ফোন করে দেখেন ফোন বন্ধ।
: এরপর সিনেমার কাহিনী, সত্য ঘটনা।
: বাবা-মা কোথায় গেলেন রহস্য রয়ে গেছে। তিনদিন পর নিজ গ্রামে ফিরলেন। সেই শতবর্ষী পুরানো ঘরের দরজা জানালা খুললেন, মাকড়সার জাল পুরো ঘরে, অসংখ্য ইন্দুর, তেলাপোকার ঘর বসতি। সববাধার জাল ছিন্ন করে নিজ ঘরে বসবাস শুরু করে অন্য ঘরের ছেলে মেয়েদের জন্য পাঠশালা খুললেন। অন্তর দিয়ে বৃদ্ধ বৃদ্ধা কাজ করে পরিত্যাক্ত ঘরকে সুখের নীড় করে তুললেন এবং লিখে দিলেন, ‘আদর্শ সন্তানই সমাজ বদলের হাতিয়ার’। পুত্র ও পুত্রবধূ আসার সাহস পায়নি। প্রচুর ছেলে মেয়ে সকাল সন্ধ্যায় পড়তে আসে। অধ্যাপক কন্যাটি স্বামী সন্তান নিয়ে বাবা-মার কুঁড়ে ঘর কাম পাঠশালায় এসে গ্রামের মানুষের সামনে ঘোষণা করলেন বাড়ির মসজিদের পাশে বাবার সামান্য জমিটিতে হবে একটি স্কুল। আজ থেকেই কাজ শুরু করুন। স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গ্রামের মানুষের আনন্দ দেখে কে? এক বিকেলে দেখেন। তাদের বড় নাতিটা একাএকা এসে দাদুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সে একদৃশ্য। তাকে শহরে পাঠানো যায়নি। মেয়ে এবং বাবা-মা শহরে গেলেন, নাতিকে পিতা-মাতার বুকে তুলে দিয়ে শুধু বললেন, স্কুলটা দেখে এসো। তোমাদের জন্য অনেক দোয়া। শেষে দেখা গেলো অসংখ্য পাখি বাড়ির গাছগুলোতে, তারাও মাথা নুয়ে স্কুলের মাঠে নামে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোয়ান্টাম মেথড : এক আত্মতৃপ্ত জীবন-পদ্ধতি
পরবর্তী নিবন্ধঅটিজম এবং সমন্বিত শিক্ষা