: বাংলা ভাষা আন্দোলন: তৃণমূলের অমূল্য তথ্য এবং গল্পে সাইকেল বাহিনী চট্টগ্রাম।
: করোনার এই সময় মানুষ পথ চলছে জীবন মৃত্যুকে হাতে নিয়ে। যারা সমাজ গবেষক তারাতো তথ্যের সন্ধানে পথের বাধাকে ডিঙ্গিয়ে এগুচ্ছে গল্পের কাহিনী সংগ্রহে বা ইতিহাসের তথ্য উপাত্ত খুঁজতে। ইতিহাস বলেছে চট্টগ্রাম হচ্ছে ইতিহাস সৃষ্টিকরা একটি অঞ্চল। সে অঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি হচ্ছে একুশের প্রথম কবিতা। রচয়িতা ছিলেন ভাষা সংগ্রামে চট্টগ্রামের আহ্বায়ক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। একুশের রাতেই তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে রচনা করলেন কালজয়ী কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি’। কবিতাটি লিখা হলো, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ঝুঁকি নিয়ে এটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করলো, লালদিঘি মাঠে চৌধুরী হারুন কবিতাটি পড়লেন। সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ করলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো, শহরময় নারকীয় নির্যাতন।
: তারপরের ঘটনাটা কি ছিলো?
: এই পুস্তিকা শহর ও শহরতলীতে প্রচার ছিলো কঠিন। কিন্তু তরুণ ভাষা সংগ্রামী ছাত্ররা পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করলেন। চ্যালেঞ্জের ভাষা ছিলো এই পুস্তিকা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে। সে চিন্তাকে সফল বাস্তবায়নে এগিয়ে এলেন দু’জন ছাত্র। একজন বদিউল আলম চৌধুরী অপরজন মোহাম্মদ হোসেন খান। তারা দু’জনই ছিলেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের চট্টগ্রামের প্রধান সংগঠন তমুদ্দুন মজলিসের উঠতি ছাত্র নেতা। তারা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপন মিশনে নেমেছিলেন। তাঁদের দু’জনের বাহন ছিলো দু’টি সাইকেল। তখন প্রকৃতির বুকে হালকা শীতের আমেজ। কবিতার পুস্তিকার পাশাপাশি তারা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লিফলেট বিলি করতেন। বদিউল আলম চৌধুরীর বাড়ি ছিলো উত্তর কাট্টলী নাজির বাড়ি। কাট্টলী শব্দের অর্থ কায়েতটুলি। কায়েত অর্থ শিক্ষিত আর টুলি মানে আবাসস্থল। কায়েতটুলী মানে শিক্ষিত মানুষের আবাসস্থল। এই কায়েতটুলী লোকমুখে হয়ে যায় কাট্টলী। একেবারে গ্রামিণ জনপদ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বদিউল আলম চৌধুরী গ্রামের মেঠোপথ পেরিয়ে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুস্তিকা পৌঁছে দিতেন। তখন গ্রামিন এলাকায় রাস্তায় বিদ্যুৎ বাতি ছিলো না। সন্ধ্যা হলেও মানুষ ঘরে ঢুকে যেতেন। শুধু মসজিদকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ পথ চলতেন হ্যাজাক বাতি বা বোম্বা বাতি বা বোম্বা চেরাগ নিয়ে। সে সময় বদিউল আলম চৌধুরীর জ্ঞাতি চাচা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী ভাষা সংগ্রামীদের জন্য একটি টাইপ মেশিন ও একটি গেসটেটনার সাইক্লোস্টাই মেশিন দিয়েছিলেন। এই মেশিন দিয়ে প্রচুর প্রচারপত্র গোপনে বের করে শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ভাষা সংগ্রামী তরুণরা। এই প্রচারপত্র বিলির সুবিধার জন্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৪টি প্রচার জোন গঠিত হয়েছিলো
১ম জোন- দক্ষিণে পতেঙ্গা উত্তরে সীতাকুন্ড
২য় জোন- বাকলিয়া চান্দগাঁও হয়ে হাটহাজারী
৩য় জোন- শহর চট্টগ্রাম অঞ্চল
৪র্থ জোন- দক্ষিণ চট্টগ্রাম।
বলা প্রয়োজন যে সাইকেল বাহিনী এতোটাই তৎপর ছিলো প্রশাসন কোন ভাবেই ভাষা সংগ্রামীদের দমন করতে পারছিলো না। বাধ্যহয়ে পুলিশ প্রশাসন বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা শুরু করে। পুলিশী হামলা যতোই বাড়ছিলো প্রচারের তেজ আরো বেড়ে গেলো। একটা সময় এলো যখন ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি’ পুস্তিকার সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো। কপি পাওয়া যাচ্ছিলোনা তখন কবিতাটির সাথে বক্তব্য সংযোগ করে সাইক্লোস্টাইল করে মুদ্রনের ব্যবস্থা করেন। ভাষা সংগ্রামের সাথে তখন চট্টগ্রামের পেশাজীবী সমাজ শক্তির সুধিজন এতোটাই জড়িত হয়ে পড়েন জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তখন প্রতিটি মহকুমা, থানা অঞ্চলে বাংলা ভাষা সংগ্রামের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হয়। সাইকেল বাহিনীর গোপন প্রচার তৎপরতা ছিলো অনেকটা গেরিলা যোদ্ধাদের মতোই। বদিউল আলম চৌধুরী নিজ এলাকায় নৌকার মাঝিদের এই প্রচার কাজে ব্যবহার করেছিলেন। সাগর দিয়ে নৌকায় করে প্রচার পত্র বিশেষ বিশেষ মাঝিদের হাতে দিয়ে বলতেন সন্দ্বীপ ও সীতাকুন্ড অঞ্চলে পৌঁছে দিতে। তমুদ্দুন মজলিসের কর্মীরা সাইকেল, নৌকায় করে গ্রামে গ্রামে পত্র পাঠিয়ে পাকিস্তানী প্রশাসনকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলেন। এই প্রচার কৌশলের বিষয়টি পুলিশ প্রশাসন বুঝতে পারেনি। তখন উত্তর কাট্টলী থেকে দক্ষিণ পতেঙ্গায় যাওয়ার অনেকগুলো মেঠোপথ ছিলো। এমন অবস্থা ছিলো বাকলিয়া, চান্দগাঁও অঞ্চলের মধ্যেও। তাদের প্রচার শুরু হতো সন্ধ্যার পর এবং চলতো গভীর রাত পর্যন্ত। স্থানে স্থানে ছিলো আশ্রয় কেন্দ্র। তখন গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতি বাড়িতে ছিলো বাংলা ঘর বা কাচারি ঘর। সেখানে বাড়ির ছেলে মেয়েরা লজিং মাস্টারের তত্ত্বাবধানে পড়ালেখা করতেন। ভাষা সংগ্রামী ছাত্র তরুণরা প্রচার পত্র বিলি করে বাড়ি ফিরতে না পারলে গ্রামের বন্ধুদের বাংলা ঘর বা কাচারি ঘরে থেকে যেতেন। সে সময় এমন অতিথি পেলে বাড়ির মানুষ আনন্দের সাথে অতিথি আপ্যায়ন করতেন। একটি স্মৃতিচারণের গল্প বলি। সময়টা ১৯৯০ এর। তখন নুর আহমদ সড়কের মেট্রোপোল চেম্বারে গুণিজনদের একটা আড্ডা হতো। সে আড্ডায় যারা থাকতেন চট্টগ্রামের শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, কবি, রাজনীতিক, রাষ্ট্রদূত সহ অনেক শ্রেণি পেশার মানুষ। এমন একটি বৈঠকী আড্ডায় প্রফেসর খালেদ সাহেবকে সামনে রেখে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে বলতে শুরু করেন ভাষা আন্দোলনের চট্টগ্রামের সাইকেল বাহিনীর কথা। তখন অধ্যক্ষ স্যার আমাদের বললেন, এখানে তোমাদের পরিচয় করে দেবো একজন সাইকেল নায়কের কথা। তিনি আমার বদি ভাই। আমরাতো বদিউল আলমকে চিনি এবং ভাষা সংগ্রামী তাও জানি। তারপর তিনি মজা করে ভাষা আন্দোলনের প্রচার সেলে সাইকেল নিয়ে বদিউল আলম চৌধুরীর ত্যাগ ও সাহসের কথা বললেন। ধনী ঘরের ছেলেতো তাই তিনি ২টি রেলি সাইকেল কিনে নিজে একটি চালাতেন এবং আর একটি দিলেন আমাকে। এই সিদ্ধান্ত প্রথমে বদি ভাইয়ের পরে অবশ্য তমুদ্দুন মজলিস জানলেন। এমন স্মৃতিকথা বলার সময় সবাই প্রচুর হাসলেন, হাসালেন। কেমন করে গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে, পুলিশ প্রশাসন কেমন করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো- এগুলো জেনে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ বললেন, এই কথাগুলোতো আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের অংশ, আপনারা লিখুন। ছাপানোর দায়িত্বতো দৈনিক আজাদী’র।
: ভাষায় আন্দোলনে চট্টগ্রামের সাইকেল বাহিনী।
: একথাগুলো যখন জানলাম তখন লিখবো ইচ্ছা ছিলো কিন্তু স্মৃতি থেকে চলে গেছে। হঠাৎ করে পুরানো একটি ডায়রি খুঁজতে গিয়ে দেখি সেই সাইকেল বাহিনীর কথা। তখন ঠিক করলাম লেখা প্রয়োজন। তাই এতোদিন পর লিখছি। ইতোমধ্যে সবাই মারা গেছেন। তাছাড়া শহর চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব লিখছি। সেজন্যই এই পুরানো স্মৃতিটি সামনে এসে গেলো। চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত ১৯জন ভাষা সংগ্রামীর প্রত্যক্ষ তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী হারুনুর রশীদ, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, এ কে এম রফিকুল্লাহ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, এম. ফরমান উল্লাহ খান, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী, বদিউল আলম চৌধুরী, মো. ইজহারুল হক, চৌধুরী শাহাবুদ্দিন খালেদ, সাইফুদ্দিন খান, ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী, অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন খান, ডা. এ বি এম নুরুল আলম, ডা. মোহাম্মদ আলী, এ কে এম এমদাদুল ইসলাম, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, রহিমা বেগম প্রমুখ (সূত্র সিরাজুল করিম মানিক) আরো ক’জন ছিলেন তবে তাঁদের নাম পাওয়া যায়নি। তবে ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল ইসলাম, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম.এ. আজিজ, এ.কে. খান ছিলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিক তারা ভাষা সংগ্রামে ছিলেন তবে তাদের নাম বেশি প্রচার পায়নি।
এখানে বলা প্রয়োজন যে চট্টগ্রামে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, কোহিনূর প্রেসের প্রতিজন কর্মী, ম্যানেজার, সম্পাদক ছিলেন ভাষা সংগ্রামের নেপথ্য সহযোগী। একুশের প্রথম কবিতাটি প্রচারে কোহিনূর প্রেসের ইতিহাসখ্যাত অবদান থাকলেও বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন মাঠের প্রত্যক্ষকর্মী এবং গোপন সেলের সাইকেল বাহিনীর প্রধান। পাকিস্তানী পুলিশ ও গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গ্রামে, গঞ্জে, থানায় থানায় এই কবিতা ও প্রচার পত্র পৌঁছে দেওয়ার ফল হয়েছিলো একুশ সম্বন্ধে শহর ও গ্রাম জেনেছিলো এবং এর মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বীজ রোপণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট