গত এক দশকে কক্সবাজার উপকূলে সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ৯০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। কিন্তু কী কারণে কাছিমের মতো একটি ‘কী-স্টোন’ প্রজাতি বঙ্গোপসাগর থেকে এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে? তা নিয়ে কী ভাবছেন পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা? কাছিম সংরক্ষণে দায়িত্বরত বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞানীরা জানান, মাত্র এক দশক আগেও সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূলের অন্তত ৫৪ পয়েন্টে শীত মৌসুমে ডিম পাড়তে আসতো শত শত মা কাছিম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অন্তত ১৩টি পয়েন্টে কাছিমের দেখা মিলছে না। বাকী পয়েন্টগুলোতেও ডিম পাড়ছে খুব কম। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে ‘এ্যানপ্রোজেনিক স্টেস’ বা মনুষ্যঘটিত কারণসমূহকে দায়ী করছেন।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শেখ নাজমুল আলম বলেন, কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের চাপ দিনদিন বেড়েই চলেছে। পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণের কারণে কাছিমের ডিম পাড়ার নিরাপদ এলাকাও সংকোচিত হয়ে আসছে। ডিম পাড়তে সৈকতে আসার পথে ট্রলারের জালে আটকা পড়েও বহু মা কাছিম মারা যাচ্ছে। মূলত এসব মনুষ্যঘটিত কারণেই কক্সবাজার সৈকতে কাছিমসহ বিভিন্ন প্রাণিকূলের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। নিরাপদ পরিবেশ পেলে তারা আবারও ফিরে আসবে, গত লকডাউনে সকলের এটাই উপলব্ধি হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রফেসর ড. রাশেদুন্নবী বলেন, কক্সবাজারে পর্যটকদের অতিরিক্ত চাপ ও পরিবেশগত অন্যান্য বিপর্যয়ের কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। আর এটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য মোটেও সুখকর খবর নয়।
কক্সবাজার সৈকতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাছিম সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজোর্ভেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। সংস্থাটির ইকোলাইফ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শফিক বলেন, সামুদ্রিক কাছিম জোয়ার প্লাবিত অঞ্চলের উপরে বালিয়াড়িতে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়তে পছন্দ করে, যেখানে সাগরলতাসহ অন্যান্য লতাজাতীয় উদ্ভিদ থাকে। কিন্তু গত এক দশকে কক্সবাজার উপকূলে কাছিমের আবাস ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বালিয়াড়িগুলোতে ঝাউগাছের বনায়নের কারণে সেখানে আর কাছিমেরা ডিম পাড়তে পারছে না। ফলে ঘন শেকড়ের কারণে ও বালিয়াড়ির অভাবে তারা অনেক সময় ডিম না পেড়েই সাগরে ফিরে যায়।
কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), জৈব সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, সামুদ্রিক কাছিম স্পঞ্জ ও জেলিফিশের মতো ক্ষতিকর প্রাণি ভক্ষণ করে প্রবালসহ অন্যান্য প্রাণির বেড়ে ওঠার আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। কাছিমের মতো একটি কী স্টোন প্রজাতির বেঁচে থাকার উপর জল ও স্থলের আরো বহু প্রাণির অস্তিত্ব নির্ভর করে। কিন্তু অপরিকল্পিত পর্যটন শিল্প ও সৈকতে ঝাউগাছের অপরিকল্পিত বনায়নের কারণে কাছিমের ডিম পাড়ার আদর্শ পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেলে আমাদের জন্য ভবিষ্যতে বিপর্যয়ই ডেকে আনবে। তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ না থাকলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পও টিকবে না। তাই একদিকে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে পর্যটনকে এগিয়ে নিতে হবে। এজন্য কক্সবাজার সৈকতে একটি আদর্শ জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
এদিকে ঝাউবাগানের কারণে কাছিমের আবাসস্থল ধ্বংস হলেও প্রতিবছর সৈকতে নতুন নতুন ঝাউবাগান গড়ে তোলা অব্যাহত রেখেছে বনবিভাগ। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ ও উপকূলীয় বনবিভাগ প্রতিবছর কক্সবাজারের বিভিন্ন সৈকতে ও দ্বীপে হাজার হাজার ঝাউগাছ লাগিয়ে থাকে। যারমধ্যে কেবল কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগই চলতি বছর নতুন করে সৈকতের ২৫ হেক্টর জমিতে ২৫ হাজার ঝাউগাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সরওয়ার আলম বলেন, ঝাউগাছ সৈকতের মাটি ধরে রাখে এবং ভাঙন ঠেকায়। সেজন্য সৈকতে ঝাউগাছই সবচেয়ে উপযুক্ত উদ্ভিদ। বনবিভাগ গত বছরও সৈকতে প্রায় ৩৫ হাজার ঝাউয়ের চারা লাগিয়েছে। আসছে বর্ষা মৌসুমেও ২৫ হেক্টর জমিতে ২৫ হাজার নতুন চারা লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ঝাউগাছের কারণে কাছিমের ডিম পাড়ার আবাস ধ্বংস হচ্ছে কীনা তা তিনি নিশ্চিত নন বলে জানান।
সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে ঝাউগাছ লাগানোর কারণে সৈকতের মাটির ক্ষয়রোধ ও ভাঙনরোধ হওয়ার তথ্যের বিরোধীতা করেন বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম। তিনি বলেন, বালিয়াড়িতে ঝাউগাছ লাগানোর কারণে বরং সৈকতের ভাঙন ও মাটি ক্ষয় বেড়েছে। সৈকতের অগ্রবর্তী অংশে বা বালিয়াড়িতে সাগরলতাসহ অন্যান্য লতাজাতীয় উদ্ভিদই উপযুক্ত। সৈকতের উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে উচুঁ বালির ঢিবি বা বালিয়াড়ি তৈরি করে সাগরলতা। এসব লতাকে বিনা বাধায় বাড়তে দিলে সৈকতে নতুন নতুন বালিয়াড়ি তৈরি হবে। সেখানে কাছিমের প্রজননও বাড়বে। কিন্তু বালিয়াড়ি আর সাগরলতা সংরক্ষণ না করার কারণে এখন আর নতুন বালিয়াড়ি তৈরি হতে দেখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, বালিয়াড়ির পেছনের সারিতে সাগর নিশিন্দা, রায়মুনিয়া ও বরইসহ অন্যান্য প্রজাতির মাঝারি আকারের একটি উদ্ভিদের সারি তৈরির পরই পর্যায়ক্রমে ঝাউসহ দীর্ঘ উচ্চতার উদ্ভিদগুলো লাগানো যেতে পারে। সৈকতের অগ্রবর্তী অংশে ঝাউয়ের মতো দীর্ঘ উচ্চতার উদ্ভিদ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আসা বাতাস হঠাৎ সৈকতে ধাক্কা খেয়ে বালিয়াড়িতে চাপ সৃষ্টি করে, যে কারণে বালিয়াড়ি মিলিয়ে যায়। কক্সবাজার সৈকতের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে তিন স্তরের উদ্ভিদ লাগিয়ে একটি জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দেন তিনি।
পৃথিবীতে সাত প্রজাতির সী-টার্টল বা সামুদ্রিক কাছিম রয়েছে। আর আমাদের বঙ্গোপসাগরে দেখা যায় তিন প্রজাতির কাছিম। যারমধ্যে ৯৯% অলিভ টার্টল বা জলপাই রঙা কাছিম। বাকী একভাগ গ্রীণ টার্টল বা সবুজ রঙা কাছিম ও হক্সবিল টার্টল। বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসা তিন প্রজাতির কাছিমের মধ্যে হক্সবিল টার্টল আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা -আইইউসিএন এর তালিকার রেডলিস্টে। রঙিন খোলসের কারণে হক্সবিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম সামুদ্রিক কাছিম হিসাবে বিবেচিত। এটি প্রবাল প্রাচীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা এবং এদের প্রধান খাদ্য স্পঞ্জ। প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে থাকা স্পঞ্জ খেয়ে এরা কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীরগুলোকে বাড়তে সাহায্য করে। এরা দৈনিক প্রায় ৪৫ কেজি পর্যন্ত স্পঞ্জ খেয়ে থাকে। হক্সবিল মাত্র কয়েক প্রজাতির স্পঞ্জ খেয়ে অন্য প্রজাতিগুলোকে বড় হতে সহায়তা করে, যাতে প্রবাল প্রাচীরে নানা প্রজাতির জীবন নিয়ে এক অসাধারণ জীববৈচিত্র্য গড়ে ওঠে। হক্সবিল টার্টলের অভাবে সমুদ্রে ক্ষতিকর স্পঞ্জ এর বৃদ্ধি খুব বেশি বেড়ে যেতে পারে এবং ধীরে ধীরে প্রবালের শ্বাসরোধ করতে পারে। যার ফলে বর্ধনশীল প্রবাল প্রচীরগুলো মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে। এছাড়া গ্রীণ টার্টল বা সবুজ কাছিম সমুদ্রের তলদেশে জন্মানো সবুজ ঘাস বা সী-গ্রাসকে পুষ্ঠির যোগান দেয়। আর একটি স্বাস্থ্যকর সামুদ্রিক ঘাসের উপর নির্ভর করে আরো অনেক প্রজাতি। হক্সবিল প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরসহ সারা বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় সমুদ্রে পাওয়া যায়। তবে কিছু উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলেও বাস করে। এরা প্রবাল প্রাচীর, পাথুরে অঞ্চল, উপহ্রদ, ম্যানগ্রোভ, মহাসাগরীয় দ্বীপ ও অগভীর উপকূলীয় এলাকায় বিচরণ করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হক্সবিলের ওজন ৪৫ থেকে ৯০ কেজি এবং উচ্চতায় ২-৩ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এ কাছিমগুলো ছোট বিক্ষিপ্ত সৈকতে ও কম ঘনত্বে একাকী বাসা বাঁধে। এরা ২ সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি ঋতুতে প্রায় ৪ বার বাসা বাঁধে এবং প্রতি বাসায় গড়ে ১৪০টি ডিম পাড়ে। তবে ২০০ টিরও বেশি ডিমও থাকতে পারে। হক্সবিল ভূমধ্যসাগরে পাওয়া যায় না।