শতবছরের জীবন পার করে বিদায় নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট, শান্তিতে নোবেলজয়ী জিমি কার্টার। গত রোববার বিকালে জর্জিয়ার প্লেইনসে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান বলে জানিয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার। জিমি কার্টারের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস।
একসময়ের বাদামচাষি কার্টার ইতিহাসের যে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে ছিলেন; গেল অক্টোবরেই তিনি জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করেন। এই ডেমোক্র্যাট ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যখন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকটে জর্জরিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিবিসি লিখেছে, জনপ্রিয়তা হারিয়ে হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করলেও তিনি মানবিক কাজের মাধ্যমে সুনাম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন, যা তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। খবর বিডিনিউজের।
তার ছেলে চিপ কার্টার এক বিবৃতিতে বলেন, আমার বাবা ছিলেন একজন বীর, কেবল আমার কাছে নয়, শান্তি, মানবাধিকার ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় বিশ্বাসী সবার কাছে। তিনি যেভাবে মানুষকে একত্রিত করেছিলেন, তাতে পুরো বিশ্ব আমাদের পরিবার হয়ে উঠেছে। এই ঐক্য ধরে রেখে তার স্মৃতিকে সম্মান জানানোর জন্য আমরা আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
কার্টার প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে জর্জিয়ার গভর্নর, মার্কিন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট এবং কৃষক হিসেবে কাজ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চার সন্তান রেখে গেছেন। তার স্ত্রী রোসালিন গত বছরের নভেম্বরে মারা যান, তাদের বৈবাহিক জীবন ছিল ৭৭ বছরের।
ক্যান্সারে আক্রান্ত কার্টার গত বছর তার চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তার বদলে বাড়িতে হসপিস কেয়ার নিতে শুরু করেছিলেন। কার্টারকে ‘একজন প্রিয় বন্ধু’ এবং ‘নীতি ও আস্থার মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি দেখিয়েছেন যে আমরা একটি মহান জাতি, কারণ আমরা ভালো মানুষ–ভদ্র ও সম্মানিত, সাহসী এবং সহানুভূতিশীল, নম্র এবং শক্তিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন, আমাদের দেশের এক সংকটকালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিমিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং সব আমেরিকানের জীবনমান উন্নত করতে তিনি তার ক্ষমতার মধ্যে সবকিছু করেছিলেন। এজন্য আমরা সবাই তার কাছে ঋণী।
শান্তি ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে তিনি সারথি হিসেবে বেছে নেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে, প্রতিষ্ঠা করেন দ্য এলডার্স। সাবেক এ প্রেসিডেন্ট প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করে। তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় কার্টার বলেছিলেন, সবচেয়ে গুরুতর ও সর্বজনীন সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্রতম মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান।
জিমি কার্টার ছিলেন বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু : জিমি কার্টার বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন বলে গতকাল সোমবার এক শোকবার্তায় জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে শোকবার্তা দেওয়ার কথা জানানো হয়।
শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গভীর শোকের সাথে আমি নোবেল বিজয়ী প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রয়াণে আন্তরিক শোক প্রকাশ করছি। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ নেতা, মানবাধিকার রক্ষার অগ্রদূত, এবং বিশ্বজুড়ে শান্তি ও গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক।
বাংলাদেশের সঙ্গে সর্ম্পক উন্নয়নে জিমি কার্টারের অবদানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট কার্টার বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন। তার রাষ্ট্রপতির মেয়াদকাল এবং এরপরেও, বাংলাদেশ–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বহুমুখী প্রেক্ষাপটে আরও শক্তিশালী ও বিস্তৃত হয়। বাংলাদেশের জন্য তার কাজ, বিশেষ করে দ্য কার্টার সেন্টারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন নিশ্চিতকরণ, এবং গণতন্ত্রের অগ্রগতিতে অবদান, বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসা ও আন্তরিকতার প্রতীক হয়ে আছে। আমরা সস্নেহে স্মরণ করি তার ১৯৮৬ সালের বাংলাদেশ সফর, যা আমাদের জনগণের জন্য এক মহান অনুপ্রেরণার উৎস ছিল।
জিমি কার্টারকে প্রিয় বন্ধু বলে সম্বোধন করে ইউনূস বলেন, প্রেসিডেন্ট কার্টার কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক রাজনীতির আইকনিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, তিনি আমারও এক প্রিয় বন্ধু ছিলেন। নোবেল বিজয়ীদের বিভিন্ন সমাবেশে তাকে একাধিকবার সাক্ষাৎ করার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে। মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারে তার অটুট অঙ্গীকার আমাকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের কথোপকথনে সবসময় ফুটে উঠত তার গভীর বিনয়, প্রজ্ঞা এবং জনগণের ক্ষমতায়নে তার দৃঢ় বিশ্বাস। সন্দেহ নেই, তার উত্তরাধিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে থাকবে। শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্টারের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
কার্টারের মানবিক, পরিবেশগত ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “একটি উন্নত, ন্যায্য বিশ্বের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। কার্টারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, শিষ্টাচার, মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সেবার জীবনযাপনের অর্থ কী– তা তিনি আমাদের শিখিয়েছেন।
রিপাবলিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছেন, কার্টার অফিসকে মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং আরও ভালো বিশ্ব গড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রচেষ্টা থেমে যায়নি।
ওয়াশিংটন ডিসিতে কার্টারের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।