সাফজয়ী পাঁচ ফুটবল তারকার পথচলা যেভাবে

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | বুধবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সাফজয়ী ফুটবলারদের মধ্যে পাঁচ ফুটবল তারকার বাড়ি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে। দরিদ্রতা ও দুর্গমতার মতো শত বাধা পেরিয়ে দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন মনিকা, রূপনা, ঋতু, আনুচিং ও আনাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনপদ থেকে উঠে আসে এসব মেয়ে তারকারা এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে। বাংলাদেশ দলের সাফ চ্যাম্পিয়নের বড় অংশীদার পার্বত্য চট্টগ্রাম। মনিকা, রূপনাদের উঠে আসার গল্পটা মোটেও সহজ ছিল না।
মনিকা চাকমা : খাগড়াছড়ির সবচেয়ে দুর্গম উপজেলা লক্ষ্মীছড়ির সুমন্ত পাড়ায় মনিকা চাকমার বাড়ি। দারিদ্র্যের পাহাড়সম বাধা ডিঙিয়ে দেশের অন্যতম তারকা ফুটবলার এই পাহাড়ি কন্যা। খাগড়াছড়ির সবচেয়ে দুর্গম উপজেলা লক্ষ্মীছড়ি জন্মগ্রহণ করলেও শৈশব থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল তার তীব্র অনুরাগ। শত বাধা ডিঙিয়ে ফুটবল শৈলির মাধ্যমে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলে ডাক পান। এরপরই বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে লেখা হয়ে গেলো মনিকা চাকমার নাম।
মনিকার বাবা বিন্দু কুমার চাকমা বলেন, পাহাড়ি এলাকায় ছোট্ট মনিকা তখন থেকেই ফুটবলের প্রতি আসক্ত ছিল। বাবা-মা হিসেবে প্রথমে মেনে নিতে পারিনি। এ জন্য প্রায় সময় মারও খেতে হত তাকে। কিন্তু আমরা এখন তাকে নিয়ে গর্বিত।
রূপনা চাকমা : সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নের সেরা গোলরক্ষক রূপনা। বাংলাদেশের শিরোপা জয়ে বড় অবদান তার। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র এক গোল হজম করেছে বাংলাদেশ। গোল প্রতিরোধে মজবুত দেয়াল গড়ে তোলা জাতীয় দলের গোলরক্ষক রূপনার বেড়ে উঠার গল্পটা সবার থেকে আলাদা। জন্মের আগেই হারান বাবাকে। মা কালাসোনা চাকমা (৬৫) অন্যের ক্ষেতে-খামারে কাজ করে দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। এ টাকা দিয়েই চলে সংসারের খরচাপাতি। তবে রূপনার সাফল্যে দিন বদল হচ্ছে কালাসোনার। সরকারি সহায়তায় তৈরি হচ্ছে ঘর।
রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলা ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের বুইয়ো আদম গ্রামে রূপনাদের বাড়ি। সেখানে গেলে রূপনার মা কালোসোনা চাকমা বলেন, আমার ৪ সন্তান। দুই ছেলে, দুই মেয়ে। রূপনা সবার ছোট। সে যখন আমার পেটে তখন তার বাবা মারা যায়। খুব অভাবের সংসার আমার। আমার কষ্টের শেষ নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। আমার মেয়ের এতটুকু যাওয়ার পেছনে ঘাগড়ার বীরসেন, শান্তিমনি বাবুদের অবদান সবচেয়ে বেশি। তারা আমার মেয়েকে ঘাগড়ায় নিয়ে ফুটবল খেলা শিখিয়েছেন। আমার মেয়ে এখন জাতীয় দলের গোলরক্ষক। মেয়ের জন্য আমি গর্বিত।
ঋতুপর্ণা চাকমা : বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মাঠে তার পায়ের জাদু খেলার নৈপুণ্য ফুটিয়ে তোলে। রাঙামাটি শহর পেরিয়ে কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের মগাছড়িতে ঋতুপর্ণাদের বাড়ি। মেঠোপথ আর ধানি জমির রাঙামাটি থেকে উঠে আসতে গিয়ে পাহাড়ের মতোই চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে তাকে। বাবা কৃষক। অনেক সময় প্র্যাকটিসে যাওয়ার টাকা থাকত না। বাবা ধার করে এনে দিতেন। বাবা বলতেন, ভালো করে খেল। জাতীয় দলে খেলতে হবে। বাবার কথা রেখেছেন ঋতুপর্ণা। কিন্তু ঋতুপর্ণার এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি তিনি।
ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান, তার সাবেক ও বর্তমান তিন ছাত্রী বাংলাদেশের জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের এই অসামান্য অর্জনে যারপরনাই খুশি তিনি। তিনি বলেন, রূপনা এখনও আমার স্কুলের ছাত্রী, ঋতুপর্ণাও এখানে পড়ত। আর মনিকা এই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছে। আমার ছাত্রীদের অর্জনে আমি গর্বিত।
ঋতুপর্ণার মা বসুবতি চাকমা বলেন, দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, আমার মেয়ে সেই দলের সদস্য। এলাকার মানুষ আমাদের সম্মান দেখাচ্ছে। দেখেই ভালোই লাগছে।
আনাই মগিনী : সাফ শিরোপা চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অন্যতম খেলোয়াড় আনাই মগিনী-আনুচিং মগিনী। তারা যমজ বোন। খাগড়াছড়ির সাতভাইয়া পাড়ায় ২০০৩ সালে আনাই মগিনীর জন্ম। দুই মিনিট পরে আনুচিংয়ের জন্ম। দুই মেয়ের জন্মে চিন্তিত হয়ে পড়েন তাদের বাবা-মা রিপ্রু মগ ও আপ্রুমা মগিনী দম্পতি।
আনাইয়ের বাবা রিপ্রু মগ বলেন, ২০১০ সালে সাতভাইয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফুটবল যাত্রা শুরু হয় মেয়েদের। আনাই মারমার ফুটবল নৈপুণ্য দেখে রাঙামাটির মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা ঘাগড়া হাই স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে জাতীয় দলের খেলার সুযোগ হয় তার।
আনুচিং মগিনী : আনাই মগিনীর জন্মের দুই মিনিট পর পৃথিবীর আলো দেখে আনুচিং মগিনী। দুই জনের গল্পটা একই সঙ্গে বেদনাদায়ক ও রোমাঞ্চকর। দুই জনের বেড়ে উঠার গল্পটা প্রায় অভিন্ন। দুই বোনের জন্মের পর তাদের বাবা-মা’র কপালে চিন্তার ভাজ পড়লেও তারাই এখন পরিবারটির আশার প্রদীপ। আনাই-আনুচিং-এর আয়ে সুখে-শান্তিতে চলছে রিপ্রু মারমা ও আপ্রুমা মগিনীর সংসার। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে এখন অপরিহার্য আনুচিং। আনুচিংয়ের মা আপ্রুমা মগিনী বলেন, আমি দুই মেয়ের জন্য গর্বিত। আমি চাই তারা ফুটবল খেলে যাক। পুরো জেলার মানুষ আমার মেয়েদের নিয়ে গর্ব করে। এটাই আমার বড় আনন্দ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৃত্যু বেড়ে ৬৮
পরবর্তী নিবন্ধআঁরার পাঁচ মাইয়্যার সংবর্ধনা আজিয়া, অনারা আইবান