আমার গুরু যখনই দীন শরতের পদ ‘বলে না ছিলেম গো প্যারী পিরিতি করিস না’ গেয়েছেন পদের একটি স্তবক সবসময় মনের অগোচরে গিয়ে ভাবিয়েছে …
‘শরৎ বলে প্রেম করিলে
পাইতে হয় যাতনা
তাই ভাবিয়া প্রেম না করে
আছে বা কয়জনা রে।।’
ভবে মহাজাগতিক মায়ায় প্রেম যাতনাময় জানা সত্ত্বেও প্রেমের অমৃত সুখ আস্বাদনে আমরা সকলেই উন্মুখ।
বাংলা ১৩১০ সালে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার সাজিউড়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন দীন শরৎ। তাঁর পুরো নাম ছিলো ‘শরৎচন্দ্র দেবনাথ’, আবার কোথাও ‘শরৎচন্দ্র নাথ’, আবার কারো মতে ‘শরৎচন্দ্র দাস’ জানা গেলেও তিনি সবার কাছে ‘অন্ধ কবি দীন শরৎ’ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন।
দীন শরৎ তাঁর গানে সহজ ভাষায় কঠিন কষ্টে কাটানো আত্মজীবনী নিজেই বলে গেছেন…
‘গুরু উপায় বলো না
জনম দুঃখী কপালপোড়া
আমি একজনা।।
শিশুকালে মইরা গেল মা
গর্ভে থুইয়া পিতা মইল চোখে দেখলাম না
আমায় কে করিবে লালন পালন গো
কে দিবে আজ সান্ত্বনা।।’
মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় পিতৃহারা হন শরৎ, মাকেও হারান শৈশবেই। পিতৃমাতৃহীন একা শরৎ জীবনে ভেঙ্গে না পড়ে দৃঢ় মনোবলে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যান স্কুলের আঙিনায়। এই দুঃখের জীবনেও নেমে আসে অন্ধকার, শোনা যায় যে তিনি নয় বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তাঁর দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন, তবে উনি সত্যিই অন্ধ ছিলেন কিনা এই নিয়ে বহু মতান্তর আছে।
পিতামাতা হারিয়ে দীন শরৎ সম্পূর্ণভাবে অনাথ হয়ে পড়েন। মনের দুঃখে গান গাইতেন তিনি আর এভাবেই শুরু হয় তাঁর গান রচনা। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গাইতেন আর সেইসব গানে তাঁর জীবনের দুঃখ বারংবার প্রতিধ্বনিত হতো সুর ও কথায়। ধীরে ধীরে সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলের বৈঠকী আসরে তাঁর গানের সমাদর বাড়তে থাকে।
জানা যায়- ব্রহ্মচারী ভারত গোস্বামী এবং সিলেটের বিথলং আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীকে তিনি গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন তাঁর জীবনে। তাঁদের কাছ থেকে তিনি সাধনপদ্ধতি, কুম্ভক, প্রাণায়াম ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেছিলেন।
শরতের নিজগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তৎকালীন যুক্তবাংলার অর্থমন্ত্রী নলিনী সরকার। দীন শরতের গানের অনুরাগী ছিলেন তিনি আর এই সূত্র ধরেই সৃষ্টি হয় তাঁদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। নলিনী সরকারের সুদৃষ্টির ফলে অনেকাংশেই মোচন হয় দীন শরতের আর্থিক কষ্ট এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় ‘দীনশরতের বাউল সঙ্গীত’ , ‘দীনশরতের এসলামসঙ্গীত’ ও ‘গৌরগীতিকা’ নামক তিনটি সঙ্গীতসংকলন বা গ্রন্থ।
বাংলা ১৩৭০ সালে মহাত্মা বাউল সাধক দীন শরৎ তাঁর দেহের মায়া ত্যাগ করে সমাধিস্থ হন।
দীন শরতের গানের ভাষা তুলনামূলকভাবে মার্জিত ছিলো মৌখিক ভাষার চেয়ে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ময়মনসিংহ অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ ছিলো লক্ষণীয়। তিনি তাঁর রচনায় তৎকালীন সময়ে প্রচলিত নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ অনায়াসেই ব্যবহার করেছেন বাংলা শব্দের মতো।
তাঁর কিছু কিছু গানে সুর নির্দিষ্ট করা থাকতো আর এই নির্দিষ্টকৃত সুরের উল্লেখ প্রাচীন চর্যাপদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
দীন শরৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাঁর গানে সংস্কৃত শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার ছিলো চমকপ্রদ।
তিনি বাউল-পরম্পরার ধারায় রচনা করেন তত্ত্ব গান। দেহতত্ত্ব, চারচন্দ্র ভেদ, পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন, রস-রতি, রজঃ-বীর্য, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ, মনঃশিক্ষা, পরমতত্ত্ব, সুমতি-কুমতি, সাধনতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ও মালজোড়া প্রভৃতি তত্ত্বসমূহ নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর রচনা।
দীন শরৎ গৃহী বাউল সাধক ছিলেন। জগৎ সংসারের মায়ায় নানাভাবে প্রশ্নবদ্ধ হয়ে উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন পরমাত্মা আর জীবাত্মার যোগে। সেইসব প্রশ্নের উত্তরে তাঁর গানে কখনো শিষ্য দাঁড়ায় প্রশ্ন করেছেন গুরুর কাছে ,আবার তিনিই গুরুর দাঁড়ায় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শিষ্যের কাছে।
দীন শরৎ তাঁর এই গানে শিষ্যের উত্তরে গুরুর দাঁড়ায় বলছেন…
কি চমৎকার ফল গো গুরু ধরে এই গাছে।
আকাশেতে গাছের গোড়া নীচেতে ডাল মেলেছে।।
সেই গাছেতে বোঁটা ছাড়া আলগা ফল ধরে,
কাটিলে সে বাঁচে সে গাছ না কাটিলে মরে।
সে ফল কাঁচা হয়ে ঝরে গেছে
আবার পাকা হয়ে বাঁচতেছে।।
সে গাছের আছে তিনটি ডাল,
দুই ডালেতে ব্রহ্মা বিষ্ণু আর এক ডালে কাল।
আছে শূন্যে একটি হংসের বাসা,
(হংসে) চার যুগে এক ডিম পাড়ে।।
দীন শরৎ বলে ডিমের নাই কুসুম,
উড়ে পড়ে সেই গাছে ডিমে না দেয় উম।
উম দিতে তার ঘুম ভেঙে যায়
চার যুগে এক মরা বাঁচে গুরু।।
চৈতন্য মহাপ্রভু ও অদ্বৈতাচার্য্যের বৈষ্ণব ধারার প্রভাব ছিলো নবদ্বীপের মতো সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেও। উক্ত অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম সকল বাউল সাধকদের সৃষ্টিতে বৈষ্ণব ধারার প্রভাব ছিলো লক্ষণীয়। দীন শরতের ‘গৌরগীতিকা’ গ্রন্থটি মূলত বৈষ্ণব ধারায় রচিত, আবার সেই সঙ্গে তিনিই রচনা করেন ইসলাম সম্পর্কিত গানের গ্রন্থ ‘দীন শরতের এসলাম সঙ্গীত’। এই অসামপ্রদায়িক মেলবন্ধনই আমাদের বাংলার বাউল ফকির পরম্পরার চিরাচরিত ঐতিহ্য।
(সনাতন সিদ্ধাশ্রম আর্কাইভ থেকে নেয়া)
তিনি বাউল-পরম্পরার ধারায় রচনা করেন তত্ত্ব গান। দেহতত্ত্ব, চারচন্দ্র ভেদ, পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন, রস-রতি, রজঃ-বীর্য, শ্বাস- প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ, মনঃশিক্ষা, পরমতত্ত্ব, সুমতি-কুমতি, সাধনতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ও মালজোড়া
প্রভৃতি তত্ত্বসমূহ নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর রচনা।