দেশের জ্বালানি তেলের একমাত্র শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন প্রকল্প আর্থিক সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন প্রকল্পটি প্রায় সাত বছর আগে অনুমোদন পেলেও আর্থিক সংকটে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। শুরুতে প্রকল্পটির পুরো ব্যয় বিপিসি থেকে যোগান দেয়ার কথা থাকলেও আর্থিক সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না। এখন বিপিসি থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ যোগান দেয়ার প্রস্তাব করে বাকি ৭০ শতাংশ অর্থের সংস্থান করার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন করা হয়েছে।
বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করার ছাড়পত্র বা অনুমোদন পাওয়া গেলে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হবে। তবে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে দেড় গুণ।
জানা যায়, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বড় অবলম্বন পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল এই রিফাইনারিতে পরিশোধন করে যোগান দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে নির্মিত দেশের একমাত্র রিফাইনারিটির সক্ষমতা কিছুটা কমে এসেছে। ফলে ক্রুড অয়েলের পরিবর্তে পরিশোধিত তেল আমদানির পরিমাণ এবং নির্ভরতা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ৫৫ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগ আমদানি করা হয় পরিশোধিত অবস্থায়। ক্রুড অয়েল থেকে রিফাইনড অয়েলের মূল্য চড়া। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেত। এ অবস্থায় ২০১০ সালে সরকার ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি-২ নামে নতুন একটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ২শ একর জায়গার এক পাশে ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের কথা। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার ১২ বছর পরও প্রকল্পটির কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে প্রকল্প ব্যয় ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৯ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা হয়েছে।
সূত্র জানায়, শুরুতে প্রকল্পটির শতভাগ ব্যয় বিপিসি নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে বিপিসি আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে বিপিসির পক্ষে প্রকল্পের শতভাগ অর্থ যোগান দেয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে অর্থের সংস্থান না হওয়ায় প্রকল্পটি বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে। প্রকল্পটির অর্থের সংস্থানের জন্য বিপিসির পক্ষ থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবে সংস্থান হয়নি। ফলে দফায় দফায় প্রকল্পটির ডিপিপি সংশোধন হলেও কাজ হয়নি। অর্থ সংকটে পড়ে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে মন্তব্য করেছেন।
ইস্টার্ন রিফাইনারির একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট প্রকল্পটি বিপিসির। বিপিসি এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানাভাবে চেষ্টা করছে। এই প্রকল্প নিয়ে ৬ অক্টোবর ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সাথে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিপিসির কর্মকর্তারা প্রকল্পটির আর্থিক সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন। তারা বলেন, বিপিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রকল্পটিও সরকারি। দেশের জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রকও সরকার। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্যই এই প্রকল্পটি নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিপিসি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে তাতে এত বড় একটি প্রকল্পের অর্থায়ন এককভাবে সম্ভব নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিপিসি প্রকল্পটির প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্থের যোগান দেবে। বাকি ৭০ শতাংশ অর্থের যোগান দিতে হবে সরকারকে। সরকার যদি ৭০ শতাংশ বা ১৪ হাজার কোটি টাকার যোগান দেয় তাহলে প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শুরু করতে বাধা নেই। প্রকল্পটিতে অর্থায়নের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের জন্যও আবেদন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলে প্রকল্পের নতুন ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপরই প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৪৫ লাখ টন তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা অর্জন করবে ইআরএল, যা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটির প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টটেন্ট (পিএমসি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেডকে। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিপিসি।
ইস্টার্ন রিফাইনারির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যানিং অ্যান্ড শিপিং) মোস্তাফিজার রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলাপ আলোচনা চলছে। মাননীয় মন্ত্রীর সাথে বৈঠক হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। করোনাকাল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় ছিল। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। প্রকল্পটির ব্যয় বিপিসি করবে নাকি সরকার করবে তা নিয়ে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। এটি ফাইনাল হয়ে গেলে কাজ শুরু হবে।