বাংলাদেশে শুধুমাত্র সাঙ্গু নদীর পার্বত্য অংশে “কপার মহাশোল” নামক এই মাছটির বিচরণ সীমাবদ্ধ। স্থানীয়ভাবে “করপ মায়াল” নাম পরিচিত এই মাছ বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সাঙ্গু নদীর পার্বত্য অংশে দেখা যায়। এই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম “নিওলিসোচিলাস হেক্সাগোনোলেপিস” (Neolissochilus hexagonolepis)। সিপ্রিনিফর্মিস বর্গভূক্ত সিপ্রিনিডি গোত্রের এই মাছটি কপার মহাশোল ও চকোলেট মহাশোল নামে সাধারণভাবে পরিচিত (ইংরেজী নাম)। বেড় জাল, ঝাঁকি জাল, ঠেলা জালসহ আরো বিভিন্ন জালে কিশোর কপার মহাশোল মাছ ধরা পড়ে। বান্দরবান সদরের মাছ বাজারে ও মারমা বাজারে দুই কেজি ওজনের কপার মহাশোল বিক্রি হতে দেখা গেছে। সাঙ্গু নদীতে এই মাছের জনসংখ্যা অত্যন্ত কম। বান্দরবান সদর উপজেলার বালাঘাটা বাজারের ডাউনস্ট্রিমে এই মাছে তেমন দেখা যায় না, তিন্দু-রেমাক্রি অঞ্চলে এর জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশী, সাঙ্গু নদীর অন্যতম পার্বত্য শাখা রেমাক্রি খালেও এই মাছ পাওয়া যায়। থানচির তিন্দু-রেমাক্রি অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে বেড়জালের প্রতি দিনের আহরণে দু-চারটা কিশোর কপার মহাশোল দেখা যায়। আইইউসিএন বাংলাদেশ ২০১৫-এর লালতালিকা অনুসারে এই প্রজাতিটি “এন্ডেঞ্জার্ড” ক্যাটাগরিতে থ্রেটেন্ড প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত এবং বৈশ্বিক থ্রেটেন্ড স্ট্যাটাস “নিয়ার থ্রেটেন্ড” হিসাবে চিহ্নিত।
বাংলাদেশের বাইরে ভূটান, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এই মাছ পাওয়া যায়।
দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এই মাছের বর্ণ নবীন বয়সে পৃষ্ঠীয় দিকে সবুজাভ ও পার্শ্বদেশ তামাটে বর্ণের থাকে, পরিণত বয়সে তামাটে ভাব কমে যায়, রূপালী আভা বৃদ্ধি পায়। পাখনাসমূহে তামাটে আভা বজায় থাকে।
রুই জাতীয় এই মাছের আঁইশ বৃহদাকার, আঁইশের সংখ্যা লম্বালম্বি সারিতে ২৮-৩২টি ও আড়াআড়ি সারিতে ৭টি। মুখে দুই জোড়া স্পর্শী স্পষ্ট দেখা যায় (এক জোড়া ম্যক্সিলারি স্পর্শী ও এক জোড়া রোস্ট্রাল স্পর্শী)। স্পর্শীর দৈর্ঘ্য চক্ষুগোলকের ব্যাসের চাইতে লম্বা। চোখ মাঝারি আকৃতির।
সাঙ্গু নদী ছাড়া দেশের অন্য কোন নদী বা জলাশয়ে এই মাছের উপস্থিতির রেকর্ড নাই। দেশে এই মাছের উপস্থিতির প্রথম রেকর্ড করেন এই নিবন্ধের লেখক (দেখুন- রেডলিস্ট অব বাংলাদেশ, ভলিয়ুম ৫:ফ্রেস ওয়াটার ফিসেজ, পৃষ্টা ৭৬, প্রফেসর মোস্তফা আলী রেজা হোসাইন, বাকৃবি)। পার্বত্য সাঙ্গু নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এই মাছের বসবাস ও প্রজননের জন্য আদর্শ স্থান। এরা নদীর তলদেশে ও তলদেশ সংলগ্ন উপরের পানির স্তরে থাকে, এবং তলদেশের খাবার গ্রহণ করে। পাথর সমৃদ্ধ তলদেশযুক্ত দ্রুত প্রবহমান নদী এদের পছন্দ। পরিণত মাছ প্রধানত সূত্রবৎ সবুজ শৈবাল খায়, পতঙ্গের লার্ভা ও চিংড়ি জাতীয় প্রাণী দ্বিতীয় পর্যায়ের পছন্দের খাবার। এরা সীমিত পরিসরে অভিপ্রয়ান করে থাকে, কখনো মোহনায় বা সমভূমি অঞ্চলের নদীতে আসেনা। প্রজননের জন্য উজানে অভিপ্রয়ান করে ও এরা নুড়ি ও পাথরে ডিম ছাড়ে। পার্বত্য সাঙ্গু নদীতে লোকালয় সংলগ্ন স্থান সমূহে খন্ড খন্ড একাধিক অভয়াশ্রম গঠন করা হলে এই মাছের অতিআহরণ জনিত ঝুঁকি হ্রাস পাবে। কপার মহাশোলের মতো আরো বেশ কয়েক প্রজাতির মাছের একমাত্র দেশিয় আবাসস্থল সাঙ্গু নদী। কয়েকটি ঝুঁকিগ্রস্ত মাছের একমাত্র আবাসস্থল হিসাবে এই নদীর পরিবেশগত সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ।