সাখাওয়াত হোসেন মজনু আমার ষাট বছর পূর্তি স্মারক গ্রন্থে এভাবেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় পর্ব তুলে ধরেছেন-
‘বাংলাদেশ তখনো হয়নি। রাজপথে মিছিল, স্লোগান। বাঙালি জাতির জন্য একখণ্ড ভূমি, স্বাধীনভাবে বাংলায় কথা বলার জন্য উন্মুক্ত অঙ্গন, মাকে মা বলার অধিকার অর্জনের সংগ্রাম তখন চরম পর্যায়ে। সে আমার দুরন্ত কৈশোরের ১৯৬৯ এর রাজপথ কাঁপানোর সময়। স্কুলের আঙিনা ছেড়ে জামালখান, পাহাড়তলী, চকবাজার, লালদীঘি, নিউমার্কেট, লালখান বাজার এলাকাগুলোতে মিছিল করতে যাওয়ার পথ চিনেছি। সে সময় অসংখ্য নতুন তরুণের অসংখ্য মুখ দেখেছি বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মিছিলে। একবার নয়, দু’বার নয়- অসংখ্যবার। সে দেখা মুখটির সাথে আবারো রাজপথে চার চোখের মিলন। ক্রমান্বয়ে আদর্শিক ঐক্য। তারপর সখ্য সম্পর্ক। এখনো ধীর পদে এগিয়ে যাওয়া আমার নিপু ভাইয়ের সাথে সখ্যের সম্পর্কটা এক বৃন্তে ফোঁটা সুগন্ধী ফুলের মতোই।’
মজনুর সঙ্গে সেই পরিচয়টার বিস্তার লাভ করতে থাকে ১৮ জুন ১৯৮৭ থেকে। যে দিন চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের স্বপ্নদ্রষ্টা সাখাওয়াত হোসেন মজনু, অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা ডা. মাহফুজুর রহমান, ডা. অহিদুল আলম, খোরশেদ আলম এবং আমি সহ জুবলী রোডস্থ মেট্রোপোল কমিউনিটি সেন্টারে সংগঠনটির গোড়া পত্তন করি। সংগঠনটিকে সাংগঠনিক রূপ দেয়ার জন্য কবি ওহীদুল আলমকে সভাপতি এবং সাখাওয়াত হোসেন মজনুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। মজনুর সাংগঠনিক দক্ষতায় চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ ক্রমান্বয়ে একটি আন্তরিকতা, সৌহার্দ্যপূর্ণ, পারস্পরিক সহযোগিতার সেতুবন্ধন হিসেবে সুবিশাল সংগঠনে পূর্ণতা লাভ করে। ইতোমধ্যে পরিষদে যুক্ত হয়েছেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমেদ, রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান, ফজলে সোবহান চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, সালাহ উদ্দিন কাসেম খান, গাজীউল হক, শিল্পপতি নাদের খান, এ. কিউ.আই চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমদ, রূপম কিশোর বড়ুয়া, ডা. কামাল এ খান, অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক, অধ্যাপক চৌধুরী মঞ্জুরুল হক, ডা. এল. এ. কাদেরী, ডা. মাহমুদুল হক চৌধুরী, ডা. নুর উন নবী, অধ্যক্ষ ফজলুল হক, অধ্যক্ষ হাসিনাা জাকারিয়া, অধ্যক্ষ রওশন আরা হানিফ, এড. শামসুল হুদা, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান প্রমুখ গুণীজন।
৩০-৩১ মার্চ ১৯৮৯ খ্রি. শতবর্ষ পুরানো চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে। তখন পরষিদের সভাপতি- অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। সাখাওয়াত হোসেন মজনু সাধারণ সম্পাদক। বিশাল আয়োজন। সারাদেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানকারী চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের মহামিলন। ঐতিহাসিক এ পুনর্মিলনীতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের নেতৃত্বে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর কর্মযজ্ঞ সবাইকে মুগ্ধ করেছে। দক্ষ সংগঠক মজনুকে চট্টগ্রামবাসী তখনই সঠিকভাবে চিনেছে। মজনুর সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাঁর ছাত্র-জীবন থেকে। স্বাধীনতা পূর্বে আগ্রাবাদ কলোনী হাইস্কুলে সে ছাত্রলীগের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল কিশোর। আগ্রাবাদ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ এবং মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন প্রকাশিত লিফলেট বিতরণ করতো সে। তার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার পর সে নিজেকে নিয়োজিত করে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ড. হারুন উর রশীদ সম্পাদিত ১০ খণ্ডের এনসাইক্লোপেডিয়া অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার (বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ) এর চট্টগ্রাম শহর অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ সরদার। সাখাওয়াত হোসেন মজনু তাকে চট্টগ্রাম শহরের তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য-উপাত্ত, অপারেশন সংবাদ দিয়ে সহযোগিতা প্রদান করেছেন। উল্লেখ আমি উক্ত গ্রন্থের উত্তর চট্টগ্রাম অংশের দায়িত্বে ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট-এর সঙ্গেও সাখাওয়াত হোসেন মজনু শুরু থেকে জড়িত হয়ে ট্রাস্টকে গবেষণা কাজে প্রচুর সহযোগিতা প্রদান করেছেন। তৃণমূল থেকে তুলে আনা মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন নিয়ে তার গ্রন্থ ‘রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক’ এবং ‘নির্যাতন’৭১’ তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রকাশনা। তাছাড়া ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহর চট্টগ্রামের বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র’, ‘মধ্যম নাথপাড়া ও আবদুর পাড়া বধ্যভূমি’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার কৈশর’ নামেও তার মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৬টি সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৩টি।
১৯৯০ খ্রি. থেকে দৈনিক আজাদীর তৎকালীন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এম.এ. মালেকের আগ্রহে তিনি দৈনিক আজাদীতে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি’ মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর লিখে গেছেন।
বাংলাসাহিত্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে সাখাওয়াত হোসেন মজনু কিছুদিন তার অধ্যয়নকৃত স্কুল আগ্রাবাদ কলোনী হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন (১৯৮৮ খ্রি.)। ছাত্র-জীবন থেকেই সাখাওয়াত হোসেন মজনু লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। ‘দৈনিক দেশ বাংলার’ কিশোর কর্মী হিসেবে। ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ সহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন। ডা. মাহফুজুর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক অনুবীক্ষণ ও স্বাস্থ্য চিন্তায়ও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। তিনি চট্টগ্রামের কৃতীপুরুষ বাদশাহ মিয়া চৌধুরী, এডভোকেট মোজাম্মেল হক, বেগম ফাহমিদা আমিন, মাহমুদুন নবী চৌধুরী, শফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ আবুল মিয়া সহ অনেকের জীবনী গ্রন্থ সম্পাদনা ও রচনা করেছেন। সুযোগ পেলেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তার অঞ্চলের অপারেশন নিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতেন। কিছুদিন আগেও নবনির্বাচিত মেয়র বীরমুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরীর ছাত্র-রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধে অপারেশন কার্যক্রম এবং তদঅঞ্চল বহদ্দারহাট-বাকলিয়া অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। রেজাউল করিমের সঙ্গে কলেজে পূর্ব পরিচিতি ও মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধা হিসেবে আমাকেও সঙ্গে নিয়েছিল সে।
অনেকগুলো সংগঠনের সফল উদ্যোক্তা সাখাওয়াত হোসেন মজনু। দুঃখজনক হলেও সত্য নেতৃত্বে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, আস্থাহীনতা, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কারণে তার অনেকগুলো থেকে মজনু নিজেকে নীরবে সরিয়ে নিয়েছে। তার অনুপস্থিতিতে অনেকগুলো সংগঠন তাদের স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে।সমাজে অবহেলিত তৃণমূল নারী ও শিশুদের জন্য সাখাওয়াত হোসেন মজনুর প্রচুর অবদান রয়েছে। তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, রক্তদান, আর্থিক সহযোগিতা, কর্মসংস্থান, আইনী সহযোগিতা যে কোন কাজে তার সহযোগিতার হাত ছিল সুদূর প্রসারিত। মেধাবী কোন গরীব ছাত্র পেলে তার আজীবন শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে তিনি পিছপা হতেন না। অনেক ছাত্র আছে যারা তার আর্থিক সহায়তা পেয়ে উচ্চ শিক্ষালাভ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজের বিপদগামী যুব সমাজকে সুস্থ জীবন লাভ করার জন্য তিনি পাড়ায় পাড়ায় বেশ কয়েকটি সামাজিক যুব সংগঠন ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সাখাওয়াত হোসেন মজনু অনেকগুলো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-* বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, * চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, * চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল, * চট্টগ্রাম একাডেমি, * চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ, * চট্টগ্রাম কলেজ ফাউন্ডেশন, * অমর একুশে বইমেলা-চট্টগ্রাম, * সম্প্রীতি ফোরাম-চট্টগ্রাম কলেজ, * মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম, * ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ ফাউণ্ডেশন, * আল্লামা রুমী সোসাইটি, চট্টগ্রাম, * মেট্রোপোল স্কলারশীপ, * কালধারা পরিষদ, * আগ্রাবাদ কলোনী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ–এ ধরনের আরো অনেক সংগঠন।
পারিবারিক ও বন্ধুমহলে সকলের কাছে ছিল তার গ্রহণযোগ্যতা। নিরহংকার, দায়িত্বশীল, পরোপকারী, নীরব কর্মী, সমাজ সংস্কারক, কলম সৈনিক, সংস্কৃতির ধারক-বাহক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা, দক্ষ সংগঠক সাখাওয়াত হোসেন মজনুর জন্ম ১৯৫৭ খ্রি. ২০ এপ্রিল। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। নিঃসন্তান সাখাওয়াত হোসেন মজনুর স্ত্রী বিশিষ্ট লেখিকা, কবি ও শিক্ষিকা মর্জিনা আখতার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা। মর্জিনা আখতার বর্তমানে সার্ক একাডেমি নামে একটি মডেল স্কুল পরিচালনা করছেন।
সাখাওয়াত হোসেন মজনুর মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা সমূহ গ্রন্থাকারে প্রকাশ এবং সমাজের অবহেলিতদের জন্য তাঁর নেয়া অসমাপ্ত কাজগুলো অব্যাহত রাখার দায়িত্ব এখন তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদেরকেই নিতে হবে। তবেই মজনুর আত্মা শান্তি লাভ করবে।
লেখক : সভাপতি, সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদ, চট্টগ্রাম।