সাইবার অপরাধ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত ‘ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এখন অপরাধের বড় হাতিয়ার’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সারা দেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় শতাধিক চক্র রয়েছে। পুলিশের তালিকার বাইরেও নতুন নতুন সাইবার অপরাধী চক্র সারা দেশে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এসব চক্রের সদস্যদের অপরাধের বড় হাতিয়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অপরাধের ঘটনায় বর্তমানে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে ১৬৮টি মামলা তদন্তাধীন। এসব মামলার মধ্যে সাত বছর আগে হওয়া মামলাও রয়েছে। শুধু তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা দিয়েই নয়, ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার ইউনিটের পরিসংখ্যানও বলছে, ২০২০ সালে ফেসবুক এবং অন্যান্য ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের ঘটনা ছিল মোট সাইবার অপরাধের ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশে। অন্যদিকে পর্নোগ্রাফি ধারণ ও অনলাইনে যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধ ২০২০ সালে ১৯ দশমিক ০৪ শতাংশ হলেও ২০২৩ সালে বেড়ে তা ২৪ দশমিক ৭০ শতাংশে পৌঁছে। চলতি বছরের গত দুই মাসে এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।’
বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম এ্যাওয়ারনেস (সিসিএ) ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। বর্তমানে দেশে যত সাইবার অপরাধ হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশের শিকার হচ্ছে নারী ও কিশোরীরা। প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা ১১ ধাপে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে চারটিই নতুন। নারী ভুক্তভোগীর হার বেড়েছে ১৬.৭৭ শতাংশ। তবে ভুক্তভোগীর ৮০.৬ শতাংশই আক্রান্ত হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগের ওপর জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে ৬৭.৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে তারা। এই অপরাধের শিকার নারীর হার ১৬.৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি। ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচারের শিকার হওয়া নারীর হার ১১.২ শতাংশ। সংঘটিত অপরাধের চেয়ে জরিপে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি। এই অপরাধ ২.২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশে।
সাইবার জগতে মানুষ যে কতটা নিরাপত্তাহীন, এই পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই সাইবার অপরাধ বাড়ার এই চিত্র উদ্বেগের। বর্তমান বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তির নিত্য নতুন উদ্ভাবনের কারণে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। সমগ্র পৃথিবী ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বাংলাদেশেও ইন্টারনেটের প্রসার ঘটছে। ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ইন্টারনেটের গুরুত্ব। এর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করে চলেছে। শহরের গণ্ডি পেরিয়ে ইন্টারনেট সেবা এখন পাড়াগাঁয়ে পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠার ফলে সব কাজ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। জ্ঞানার্জনের উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট সব শ্রেণির মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ইন্টারনেটকে বাদ দিয়ে আধুনিক সমাজকে ভাবা যায় না। তথ্যপ্রযুক্তির নানা সুফল ক্রমেই মানুষের কাছে সহজলভ্য হচ্ছে। বলা চলে, এখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ করা সহজ হয়েছে। কিন্তু দুখের বিষয় যে, ‘তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার ক্রাইম বা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অপরাধও দ্রুত বেড়ে চলেছে। নিরীহ মানুষ নানা ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন। আবার সরকারের বিরুদ্ধেও নানা ষড়যন্ত্র চলছে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে। রটানো হচ্ছে নানা ধরনের গুজব। বিভিন্ন গোষ্ঠীকে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক অপরাধ যেমন ঘটছে, তেমনি ছড়ানো হচ্ছে উগ্র সামপ্রদায়িকতা। দিন যত যাচ্ছে এই সাইবার অপরাধ তত বাড়ছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে পর্যাপ্ত ফরেনসিক ডিভাইস নেই এবং এ বিষয়ক ল্যাবও তেমন গড়ে ওঠেনি। ফলে সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার হলেও উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে ভুক্তভোগীকে আবার হুমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে অপরাধ দমনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে আরো সক্রিয় হতে হবে।