জাঁদরেল রিপোর্টার মোস্তাক আহমদ, রিপোর্টার পদে যার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে দৈনিক জমানা পত্রিকায় ওয়েজ বোর্ড নির্ধারিত বেতনে। যদিও দৈনিক ইনকিলাবের দীর্ঘ সময়ের ব্যুরো প্রধান থাকায় মোস্তাক আহমদের রিপোর্টার পরিচয়টা আমরা ততটা সন্ধান করিনি। অথচ সেখানেই চট্টগ্রামে এক জাঁদরেল রিপোর্টার হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করেন। যে ইনকিলাব সেই সময়ে সারাদেশে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করেছিল।
যেখান থেকে রিপোর্টার মোস্তাক আহমদকে স্বরূপে চেনা শুরু। সাংবাদিকতা পেশার মাধ্যমে দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। রিপোর্টিং পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে মা–বাবা, স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে নিরাপত্তা সঙ্কটেও পড়েছেন। তবু তিনি পিছু হটে যাননি।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তাক আহমদের আরো সমুজ্জ্বল পরিচয় আছে। তিনি সাংবাদিকদের নেতা। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সহ বিভিন্ন পদে নির্বাচিত নেতাও। এসব পরিচয়ের বাইরেই তিনি তার প্রকৃত পরিচয় ব্যক্ত করেছেন কর্ম ও পেশার ভিত্তিতে রিপোর্টার হিসেবে। সেটাই তার অহঙ্কার ও গৌরবের জায়গা।
সাংবাদিকতার সবচেয়ে ঝুঁকি হচ্ছে রিপোর্টিংয়ে কাজ করা। যাকে বাইরে পদে পদে লড়াই করতেই হয়। সেই সাথে আবার অফিসেও। শুধু কাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। জবাবদিহিতাও অনেক বেশি। সাংবাদিকদের লড়ে যাওয়া এই পেশার কথাই সগৌরবে বলেছেন মোস্তাক আহমদ ‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী’ গ্রন্থে। একজন পেশাদার রিপোর্টার হবার কারণেই কত কত সকালে তাকে প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়েছে অতি সতর্কতায়, সন্তর্পণে। এমনকি রিপোর্টিংয়ের কারণে তার ছেলে সন্তানদের তিনি নিরাপত্তাহীন করে তুলেছেন। বারবার তার প্রাণনাশের যে হুমকি আসে তাও শুনলে বেশ অবিশ্বাস্য মনে হবে।
তিনি লিখেছেন, ‘একটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে তারা পুনরায় নতুন কৌশল নিতো। তারা আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে তাবিজকবজ পাঠাত। সেখানে কাফনের কাপড় এবং নানারকম সুগন্ধি দ্রব্যাদি মেশানো থাকত।’
এমন বহুবার তিনি প্রাণনাশের শঙ্কায় ছিলেন। যে কারণে নিজের জন্য তিনি একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেন। সেটা ‘আমি বাসা থেকে বের হয়ে বিভিন্ন দিক পরিবর্তন করে অফিসে পৌঁছতাম। অফিসে কড়া পাহারার ব্যবস্থা ছিল। আমার চেম্বারে পৌঁছতে দুটি লোহার এবং দুটি কাঠের দরজা পেরিয়ে যেতে হবে। যা অল্প সময়ের মধ্যে কোনো প্রকারেই ভাঙ্গা সম্ভব ছিল না’।
এটা ছিল অফিসে, কিন্তু অফিসের বাইরে তার চলাফেরা ছিল আরো বিপদসঙ্কুল। প্রতিদিন একই পথে চলাফেরা করতেন না। কিভাবে পরিচয় গোপন রেখে বাসায় যাওয়া বা পথেঘাটে চলাফেরা করতেন সেসব ঘটনার কারণ না পড়লে বলে বুঝানো যাবে না। কিভাবে তিনি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের কর্মীর মত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতেন– সেসব গা শিউরে উঠার মত ঘটনা। তারপরও রিপোর্টার হিসাবে তিনি কোথাও আপোস করেননি। বিবেকের পরামর্শ ও পেশার মহত্বকে ধারণ করছিলেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। কাজ করেছেন দেশ ও সমাজ পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে। যেকারণে ‘সাক্ষাৎ যমদূত’ এলেও তিনি পরোয়া করেননি।
‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী’ গ্রন্থে মোস্তাক কখন কীভাবে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন কিংবা প্রাণের শঙ্কা নিয়ে কাজ করে গেছেন – সেসব ঘটনা, রিপোর্টিংয়ের প্রেক্ষাপটকে বেশ রোমাঞ্চকরভাবে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের নামের সাথে ঘটনার সত্যতাও বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। সাংবাদিকতায় মোস্তাক আহমদের তখনকার সময়কালের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি দেখতে হবে। তাহলে ঝুঁকির বাস্তবতাটা অনুধাবন করা যায়।
৭৫ এর আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তখনকার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নিরিখে গড়ে উঠা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। অনেকক্ষেত্রে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল সর্বত্রই। তাই চোরাচালান, দুর্নীতি, দস্যুতা, মাদক, সন্ত্রাস, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রে নানা অপরাধের ঝনঝনানি। আর এসবের বিরুদ্ধে ছিল রিপোর্টার মোস্তাক আহমদের কলমের লড়াই। সার পাচার, অবৈধ মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, সন্ত্রাসী, স্বর্ণ চালান, সীমান্তের চোরাচালানি ইত্যাদি ছিল তার রিপোর্টিং আইটেম। এসবের বিরুদ্ধে কলম গর্জে উঠেছিল রিপোর্টার মোস্তাক আহমদের। আর গেড়ে বসা এরকম অপরাধ সাম্রাজ্যের ভিত ভেঙে পড়েছিল তার অসংখ্য প্রতিবেদনে।
এরকম অজস্র প্রতিবেদনের ঘটনা, স্মৃতি কাহিনি নিয়েই রচিত মোস্তাক আহমদের ‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী’। টাকা পাচার, কাস্টমসের অনিয়ম, ফটিকছড়ির সশস্ত্র সন্ত্রাসী রাজনীতি, ছিনতাই, দ্রব্যমূল্য, ছেলেধরা, শিশু অপহরণ সহ নানা ঘটনায় চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার ৮০ ও ৯০ এর দশক ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সময়ের ইতিহাসও বলা যায় এসবকে। কিন্তু ঘটে যাওয়া তখনকার যেকোনো বিশাল বিশাল অপরাধ দুর্নীতির খবর মোস্তাকের ‘শিকারি দৃষ্টি’ ভেদ করতে পারত না। সমুদ্র থেকে উপকূল, নগর কিংবা মফস্বল, পার্বত্য গহীন পাহাড়ের অপরাধ, ঘটনা তার অনুসন্ধানী কলমের লেখনি থেকে ছাড় পায়নি। যত বড় মাফিয়া চক্রই হোক তিনি জাল বসাতেন।
তিনি লিখেছেন, ‘একেবারে জীবন বাজি রেখেই আমার রিপোর্টিং এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। তখনকার দিনে আমার রিপোটিং আইটেম ছিল চোরাচালান, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, পাহাড় পর্বতের গহীন অরণ্যে অস্ত্র তৈরির কারখানার নিত্যনৈমিত্তিক খবর, বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনা, মাঝিমাল্লাদের উপর জলদস্যুদের আক্রমণের নিউজ…। ‘
চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক খবর, রেলের দুর্নীতি, মহিউদ্দিন চৌধুরীর কারফিউ হরতাল, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সেইসব দিনলিপি কিছুই বাদ পড়েনি। শুধু অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদনই নয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত–শিবির সবার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পাশাপাশি তাদের দেশ হিতৈষী রাজনৈতিক কার্যক্রম সব ছিল তার অনুসন্ধানে। চট্টগ্রামের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে চট্টগ্রামের জনসম্পদের সকল ঘটনাই তিনি তুলে ধরেছেন রিপোর্টারের কলমে। নানা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে।
একই সাথে ভাবতেন তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়েও। চট্টগ্রামের নেতাদের রাজনৈতিক হানাহানিতে কীভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছিল, চট্টগ্রাম পিছিয়ে পড়েছে চট্টগ্রামবাসীর সেই হতাশার কথাও তিনি তুলে ধরেছিলেন তার রিপোর্টে।
যে কারণে ‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী‘ একজন রিপোর্টারের বয়ান হলেও বইটি একইসাথে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের এক সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের খণ্ডচিত্রও। সেই সময়ের এমন ছিটেফোটা বিশ্লেষণ কিংবা চিত্রনির্মিতি চট্টগ্রামে কারো লেখায় ইদানীং নেই। চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা আধিপত্য থেকে চট্টগ্রামে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যা–সব। কোনো সূত্রই কলম এড়িয়ে যায়নি সাংবাদিক মোস্তাক আহমদের। ঘটনার বিশ্লেষণ, আলোচনা–সমালোচনা এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের আতশি কাচে ধরা পড়েছে।
১৯৫৫ সালে জন্ম নেন মোস্তাক আহমদ। তাহলে প্রায় ৬৮ বছরের বয়সী একজন সাংবাদিকের দেখা–বোঝা–লেখা ঠিক একজন জহুরির মতই তো হবে।
মোস্তাক আহমদের এই লেখক সত্তার শুরু হয়েছিল অতি শৈশবে–১৯৭০ সাল থেকে। শিশুসাহিত্য চর্চায় ছিল তার ঝোঁক। লিখেছেন নাটক, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লেখালেখিও করেন তিনি। এই লেখালেখির মেধা ও ইচ্ছাশক্তি তাকে টেনে নিয়ে যায় সাংবাদিকতার দিকে। তবে এই ঘটনার আরও গল্প আছে। তার গ্রামের স্কুলে এক বিশিষ্ট রাজনীতিকের অতিথি হয়ে আসা। যাকে দেখতে তার বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। নানা ঘটনাপ্রবাহে তার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হবার পর যাদের অবদান তাদেরও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন সাংবাদিক নেতা মোস্তাক আহমদ। তাদের মনে রেখেছেন কৃতজ্ঞতায়। যারা তার কর্মপ্রতিভাকে মূল্যায়ন করে জায়গা তৈরি করে দিয়েছিলেন। বহু পথ হেঁটে এরপর তার পেশার পূর্ণতা ও পরিতৃপ্তি নিয়ে আসে দৈনিক ইনকিলাব। দৈনিক জমানা দিয়ে শুরু করে দৈনিক নয়াবাংলা, দৈনিক সেবক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন। তবে ইনকিলাবে রিপোর্টার হিসাবে সুবর্ণ সকল অর্জন চট্টগ্রামের চোরাচালান সাম্রাজ্য তছনচ করে দেওয়া রিপোর্টার মোস্তাক আহমদের। এভাবে কাজের ব্যাপক পরিসরে তার বিখ্যাত হয়ে উঠা, মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে সাংবাদিক সত্তার স্ফূরণ ঘটে। যে কারণে তিনি অনুকরণীয় অনুসরণীয়।
‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী‘ তাই তরুণদের তো বটেই সব সাংবাদিকের পড়া দরকার। সেখানে আজও বহু নিউজের সূত্র ঘুরছে। অনেক ফলোআপের খবরও।
বইটি সাধারণ পাঠকের জন্যও দরকার। কারণ সেখানে ঐতিহাসিক তথ্যগুলোও বেশ জোরালো। যা সাধারণ মানুষের আর মনে নেই– নানা সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে।
৪৪৮ পৃষ্ঠার ৫০০ টাকা দামের ‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী’ প্রকাশ করেছে আবির প্রকাশন। নান্দনিক প্রচ্ছদের স্রষ্টা মঈন ফারুক। অধ্যায় হিসাবে না হলেও পাঠক্রমে পঁচাত্তরটির বেশি লেখা আছে। সমৃদ্ধ লেখনি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তাক আহমদের। আন্তর্জাতিক ঘনঘটার প্রবাহও আছে– ‘চেরনোবিল দুর্ঘটনা প্রসঙ্গ‘, ‘নেদারল্যান্ডের বদ্বীপ প্রকল্প’ সহ অনেক বিষয়।
মোস্তাক আহমদের দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় তাকে অনেক চড়াই উৎরাই অতিক্রম করতে হয়েছে। অনেকগুলো পত্রিকায় তাকে মেধা–শ্রম ও অনুসন্ধিৎসু মনোবীক্ষণের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। এটা গড়পড়তা সাংবাদিক পরিচয়ে বোঝানোর বিষয় নয়। এত সাহসিকতার সহিত তার যে রিপোর্টার হিসাবে চূড়ান্ত যাত্রা তার দৃষ্টান্ত এই অঞ্চলে নেই। বেশিরভাগই কোথাও কয়েক বছরের সাংবাদিকতায় নাম থোয়ানো, বা সাংবাদিকতার নাম ভাঙানো। তারপর সংগঠন কেনাবেচা করে আখের গোছানোর পাঁয়তারা।
মোস্তাক আহমদের বইটি পড়লে ‘নাম ভাঙানো সাংবাদিকতার’ বৃত্ত থেকে বের হওয়ার পথও আছে। পরিশ্রম ও মেধায় শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করার পথরেখা। রাজনৈতিক শাসনই ভিন্ন ভিন্ন সময়কে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দিয়েছে। সেই সময়টা তিনি কীভাবে জয় করেছেন– সেসব ঘটনাচিত্র।
লেখক : সাংবাদিক