সহিংসতা নয়, সহিষ্ণুতার রাজনীতিই কাম্য

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সকলের জানা; করোনা অতিমারি অতিক্রান্তে সমুদয় প্রাক্কালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে প্রায় বিপর্যস্ত পুরো বিশ্বের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত প্রতিটি দেশেই ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি জনজীবন-জীবিকা নির্বাহে দুঃসহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর প্রবল আঘাত প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকেও অনেকাংশে করছে আতঙ্কিত। সামগ্রিক অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতা খুব সহজেই কাটবে না বলেই অনুমেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার চাপে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের মূল্য জনগণের উপার্জনের সাথে ভারসাম্য রক্ষায় নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নতুন করে আশঙ্কা ছড়াচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিশেষজ্ঞদের মতে রাজনৈতিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে দেশের অর্থনৈতিক সংকট অধিকতর ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করবে যা কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব-সহনশীল ভূমিকা প্রত্যাশিত। ইতিমধ্যে বিরোধী দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষসহ হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। আগামী ডিসেম্বর মাসকে ঘিরে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে রাজনীতির মাঠ। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মাঠ দখলের ঘোষণায় দেশের আপামর জনমনে গভীর উৎকন্ঠা নির্মিত হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতির বিপর্যস্ততায় রাজনীতি বিপন্ন হয়ে পড়ে। অর্থনীতি যদি ভালো থাকে, মানুষের আয়ের উপায় ও ক্ষুধা নিবারণ নিশ্চিত করা যায় তখন রাজনৈতিক সহিংসতা হালে খুব একটা পানি পায় না। বিজ্ঞজনের মতানুসারে, যেকোন জাতিরাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। কোন ধরনের অনর্থক ইস্যুকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় শুধুমাত্র রাজনৈতিক বৈরীতার কারণে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টির অপতৎপরতা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের মঙ্গলের জন্য রাজনীতির বুলি উচ্চারণে জীবন বিপদগ্রস্ত করার অপরাজনীতির আশ্রয় গ্রহণ মোটেও সমীচীন নয়। মহান স্বাধীনতার বিজয় গৌরবে উদ্দীপ্ত মাসে কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাজনৈতিক বিরোধ-বিচ্ছেদ জনগণকে হতাশাগ্রস্ত করবেই। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ অমূল্য-পবিত্র সাংবিধানিক বিধান-বার্তায় বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দল-উপদলের কর্মযজ্ঞের মৌলিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণের জীবনমান-সম্পদ-নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখার প্রায়োগিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

রাজনৈতিক শোডাউনের নামে জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দেশপ্রেমিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ শক্তিকে অযথা প্রশ্নবিদ্ধ করার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে নানামুখী হুঙ্কার মোকাবেলায় ইতিমধ্যেই আগাম ব্যবস্থা গ্রহণে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাসহ জোরদার করা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারী। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমরা আইন ও বিধি অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব পালন করব। পুলিশ এখন ইন্টেলিজেন্সনির্ভর কাজ করে। আগাম তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়। এ কারণে গত কয়েক বছর ধরে দেশে তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ডিসেম্বর মাসে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। ঐ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা আমাদের প্রস্তুতি শুরু করেছি। যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয় সে ব্যাপারে আগাম ব্যবস্থা নিতে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা যেহেতু আগে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছি, তাই আশা করছি সব ধরনের আশঙ্কা দূর হয়ে যাবে। তারপরও যদি কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চায় তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে, কে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী আমরা তা বিবেচনা করব না।’ অতিসম্প্রতি বিরোধী দলের নেতারা দলীয় নেতা-কর্মীদের লাঠি ও লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ রাজধানীর মিরপুর এলাকায় বিরোধী দলের সমাবেশে হাতে রড-লাঠি সহকারে সহস্রাধিক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বরও হাজারীবাগে লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে শোডাউন করে বিরোধী দল। ১৫ অক্টোবর ২০২২ সম্মানিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লাঠিসোঁটা নিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের সমাবেশে আসা নিয়ে সতর্ক এবং বিষয়টি আইনসিদ্ধ নয় বলেও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা লক্ষ্য করেছেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘোষণা দিয়ে বলে দেয়া হয়েছিল তারা যেন লাঠিসোটা নিয়ে আসে। এটা কী ইঙ্গিত বহন করেছিল, আমরা সেটা জানতাম না, জানিও না। আমরা লক্ষ্য করেছি, ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় পেছনে লাঠি এবং সামনে লাঠির উপরে তাদের দলীয় পতাকা উড়িয়ে এসেছে। এগুলো কী মিন করে আপনারা নিজেরাও বুঝেন এবং জানেন। আমরা তাদের বলি, আপনারা নির্বিঘ্নে আপনাদের পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটিস করুন, সেখানে আমাদের কিছু ভাবার নেই কিন্তু লাঠিসোঁটা ক্যারি করা আইনগত সিদ্ধ নয়।’

ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নীতিনির্ধারকদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি। বিরোধী দল যেসব কর্মসূচি পালন করছে তা তাদের চূড়ান্ত কর্মসূচি নয়। ফলে এখনই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে তারা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখার বিষয়ে অবহিত করেন। বিরোধী দল চূড়ান্ত আন্দোলনে গেলে বা ‘সহিংস কর্মকান্ড’ শুরু করলে পালটা কর্মসূচি দেওয়ার এবং এর আগ পর্যন্ত সারা দেশের নেতাকর্মীদের উসকানিতে পা না দিতে সতর্ক অবস্থানে থাকার জন্য দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা- নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এ সম্পর্কে বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁদের মতে, এখন পরিস্থিতি যাই হোক না কেন তা শেষ পর্যন্ত আরো সহিংস হওয়ার আশঙ্কা নেই। নির্বাচনের অনেক বাকি। ভোটের আগে রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ অনেক পাল্টে যাবে। আরো অনেক সমীকরণ আছে। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য সব দিক থেকে সরকার এবং সব দলের উপর চাপ রয়েছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কারুরই ২০০৬ সাল বা ২০১৪ সালের মত পরিস্থিতি তৈরি করার অবস্থা আছে বলে মনে হয় না। বিএনপি রাস্তায় শোডাউন করে এখন তাদের শক্তিমত্তা দেখাতে এবং সরকারের টেম্পারটাও বুঝতে চাচ্ছে। আর সরকারের ধারণা বিএনপি যদি এভাবে মাঠে নেমে তাদের জনপ্রিয়তা দেখাতে পারে তাহলে সরকারকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত একটা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সরকার তা চায় না বলেই এখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এটা আরও বাড়বে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না, এভাবেই চলবে। বিষয়টি পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে সকল দলই দেশের স্বার্থে সংযত-বিদ্বেষবিহীন কর্মকৌশল বাস্তবায়নে তৎপর থাকবে।

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত আসক এর হালানাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের নয় মাসে দেশে ৩৮৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫৮ জন নিহত হয়েছে। যার মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাতে প্রাণ গেছে ৪৮ জনের। পক্ষান্তরে এই ৪৮ জনের মধ্যে ৪৪ জনই নিহত হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতে। নিহতদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের আছে ১৮ জন, বিরোধী দলের ৬ জন এবং রাজনৈতিক পরিচয়হীন রয়েছে ৩৪ জন। উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ্য সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫ হাজার ৪০০ জন আহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, বিরোধী দল বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাতের ৩৭টি ঘটনায় ৪ জন নিহত এবং ৯২৯ জন আহত হয়েছে। এছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতে হতাহতের বিবরণে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল ও এর বিভিন্ন সহগোযী সংগঠনের অন্তর্কোন্দলে ৭৩টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৮ জন নিহত এবং ৮৯৫ জন আহত হয়েছে। বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ১৭টি ঘটনায় নিহত ও আহত হয়েছে যথাক্রমে ১ ও ২১১ জন।

রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার মাধ্যমে সৃষ্ট সংকটে দেশের গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হলে কতিপয় ক্ষমতালিপ্সু স্বৈর-সেনা শাসকদের বশংবদ সামরিক-বেসামরিক আমলা অশুভ যোগসাজসে জনগণকে বিপথগামী করার কদর্য চক্রান্তে লিপ্ত হতে পারে। অবশ্যই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দেশের জনগণ যেকোন সময়ের তুলনায় অধিকমাত্রায় সচেতন। উন্নয়ন-অগ্রগতির তুলনামূলক দৃশ্যপট বিবেচনায় তাদের যুক্তি-জ্ঞাননির্ভরতা অনেক প্রখর। শত প্রলোভন বা প্রতিশ্রুতি আপামর দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার তেমন কোনো সুযোগ নেই। তবুও অভিশপ্ত নাগ-নাগিনীর ছলচাতুরী-অভিনয় শৈলী, পদ-পদায়ন-পদক দখলের পারদর্শিতা এবং অনৈতিক অর্থ লেনদেন-লবিং তদবির বাণিজ্যের আড়ালে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে দেশকে আবদ্ধ করার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া সঠিক হবে না। জনশ্রুতি মতে, উচ্চ শিক্ষা থেকে শুরু করে সরকারের অধীনস্ত সকল প্রতিষ্ঠান-সংস্থার কর্তা ব্যক্তি-উর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্তাশ্রীত আবেগের অনুকম্পা সম্বলিত হাতেগোনা উপদেষ্টা-এমপি-মন্ত্রী ও কথিত রাজনীতিকদেরও কঠোর নজরদারিতে রাখা অনিবার্য। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার একার পক্ষে প্রতিটি বিষয়ে তদারকি কিছুতেই সম্ভব নয়। বর্ণচোরাদের মুখোশ উন্মোচন ও চিহ্নিত নষ্ট চরিত্র-বোল পাল্টানো ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে বিতাড়ন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। সময়ক্ষেপণ না করে পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকার ও দলের প্রতি বিনীত নিবেদন পেশ করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট
সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধসুধাকণ্ঠ প্রেম