সরকারি পানির বেসরকারি বাণিজ্য

১১ বছর ধরে বিল পরিশোধ করেও পান না ওয়াসার পানি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৯ মে, ২০২১ at ৩:৪৭ পূর্বাহ্ণ

এগার বছর ধরে ওয়াসার বিল দিলেও কোনোদিন এক ফোটা পানিও পাননি কাঠগড়ের ওয়াহিদ হাসান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দিনের পর দিন দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়েছি। এলাকাবাসীর পানির কষ্টের কথা লিখিত এবং মৌখিকভাবে জানিয়েছি। উপকূলীয় এলাকা পতেঙ্গার অন্তত তিন লাখ মানুষ বছরের পর বছর ধরে ওয়াসার পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এলাকায় পানির এই আকালকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র ওয়াসার পানির ব্যবসাই শুরু করেছে। এলাকার হাজার হাজার মানুষ প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে ‘সরকারি পানি’ কিনে নিচ্ছে ‘সাধারণ ব্যবসায়ীদের’ কাছ থেকে।
সরজমিনে এলাকা ঘুরে বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কাঠগড় থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার মানুষের সবচেয়ে বেশি কষ্ট পানির। এলাকায় ওয়াসার লাইন থাকলেও পানি পাওয়া যায় না। আবার টিউবওয়েল বা ডিপ টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ততার জন্য মুখে দেয়া যায় না। লাইনে পানি না পেলেও এলাকার মানুষকে ওয়াসার পানি কিনেই খেতে হয়। রান্নাবান্নায় ব্যবহার করতে হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ওয়াসার পানি সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে খাচ্ছেন। যাদের সামর্থ নেই তারা লবণাক্ত পানি দিয়েই খাওয়া-দাওয়াসহ প্রাত্যহিক প্রয়োজন মিটাচ্ছেন। এতে করে অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি খাওয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন হাজার হাজার মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ওয়াসার লাইন থাকলেও আমরা পানি পাই না। আমাদের এলাকায় ঘরে ঘরে ওয়াসার সংযোগ রয়েছে। আমরা নিয়মিত বিলও দিই। কিন্তু কোনোদিন এক ফোঁটা পানিও পাইনি। মোহাম্মদ ওয়াহিদ হাসান নামের সমাজকর্মী নিজের বিলের কপি দেখিয়ে বলেন, গত এগার বছর ধরে বিল দিচ্ছি। কিন্তু লাইনে কোনোদিন ওয়াসার পানি দেখিনি।
সিমেন্ট ক্রসিংয়ের পর থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত পুরো এলাকাতে ওয়াহিদ হাসানের মতো হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন যারা বিল দেন, কিন্তু পানি পান না।
মোহাম্মদ আরিফুর রহমান নামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমাদের পানির কষ্ট ভয়াবহ। ওয়াসার পানি আমরা পাই না। টিউবওয়েলের পানিও খাওয়া যায় না। আমাদের পানি কষ্ট কারবালার কষ্টের মতো। সরকারি পানির বেসরকারি বাণিজ্যের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে পতেঙ্গা-কাঠগড়ের বাসিন্দারা।’
স্থানীয় মুন বেকারির মালিক সিরাজুল ইসলাম গত ১২ বছর ধরে প্রতি মাসে ওয়াসার বিল দিলেও পানি না পাওয়ার কথা জানান। একইভাবে ওয়াসার পানি না পেলেও বিল দেয়ার কথা জানান, স্থানীয় আহমেদ হোসাইন, মোসলে উদ্দীন তুলি। স্টিলমিল এলাকার অসংখ্য বাসিন্দা পানির হাহাকারের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ঠিক হয়ে যাবে এমন একটি আশা থেকে সংযোগ নিয়ে বিল দিচ্ছি। হয়তো আজ না পেলেও কাল পাবো এমন একটি আশা। কিন্তু এই আশা করতে করতে বারো বছর পার করে দিলেও এক ফোটা পানি না পাওয়ার কষ্ট কাউকে বুঝাতে পারলাম না।
তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্থানীয় সংঘবদ্ধ একটি চক্র ওয়াসার পানি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকার বেসাতি করছে। তারা জানান, সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় ওয়াসার একটি গেটবাল্ব রয়েছে। যেই গেটবাল্ব দিয়েই মূলত পানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গেটবাল্বটি খোলার সাথে সাথে এলাকার পানি ব্যবসায়ীদের অত্যন্ত শক্তিশালী মোটরগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা ওয়াসার লাইনের পানি টেনে নিজেদের রিজার্ভারে জমা করে ফেলে। একেকটি পানি বিক্রির সেন্টারে ২০-৩০ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার রিজার্ভার রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। এসব রিজার্ভারে পানি ভর্তি করতে অত্যধিক শক্তিশালী মোটর ব্যবহার করা হয়। যেগুলো চালু করা হলে লাইনের পানি আর পতেঙ্গার দিকে যায় না। পরে এ পানি ড্রাম ভর্তি করে করে বিক্রি করা হয়। ২৫ লিটারের এক ড্রাম পানি ৩০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এলাকার ভবনের অবস্থান এবং বাসার ফ্লোরের অবস্থানের উপর পানির দর নির্ভর করে। নিচতলার বাসায় ত্রিশ টাকায় পানি দেয়া হলে চতুর্থ তলার জন্য নেয়া হয় ৪০/৫০ টাকা। দোকান থেকে দূরত্ব ভেদেও বাড়ে পানির দাম। এলাকার বন্দরটিলা থেকে টিসিবি ভবন পর্যন্ত এলাকায় ওয়াসার পানি বিক্রির অন্তত চল্লিশটি সেন্টার গড়ে উঠেছে। যারা সবকিছু ম্যানেজ করে দিনের পর দিন ওয়াসার পানি বিক্রি করে আসছে। এলাকায় কয়েকশ’ পানি সরবরাহকারী ভ্যান রয়েছে। যেগুলোকে দিনভর সেন্টারগুলো থেকে পানি বোঝাই করতে দেখা যায়।
পানি ব্যবসায়ী এই সিন্ডিকেটই ওয়াসার গেটবাল্ব অপারটেরকে ম্যানেজ করে পানি যাতে কাঠগড়সহ পতেঙ্গার দিকে না যায় সেই ব্যবস্থা করে থাকে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ড্রাম পানি বিক্রি করা হয় বন্দরটিলাসহ ইপিজেড এলাকার বিভিন্ন সেন্টার থেকে। এই ধরনের একাধিক সেন্টার ঘুরেও গতকাল কোনো মালিকের দেখা পাওয়া যায়নি। তবে কর্মচারীরা একেকটি সেন্টার থেকে প্রতিদিন এক দেড় হাজার ড্রামের মতো পানি বিক্রি করার কথা স্বীকার করেন। তারা বলেন, আমরা ভ্যান চালকদের ড্রাম ভরে পানি দিয়ে দিই। তারাই এলাকার মানুষের কাছে পানি পৌঁছে দেয়। এলাকার মানুষ ফোন করলে বাসায় বাসায় পৌঁছে দেয়া হয় পানি। বাসার লোকেশন এবং কোন ফ্লোরে পানি উঠাতে হয় তার উপরই পানির দাম বাড়ে। বন্দরটিলাসহ সন্নিহিত এলাকায় অন্তত ২৫টি দোকান থেকে সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি ভ্যানে ভ্যানে পানি বিক্রি চলে।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এখন শহরের কোথাও পানির কোনো সমস্যা নেই। পতেঙ্গা এলাকায় কেন এমন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি পতেঙ্গার বহু এলাকায় ওয়াসার সংযোগ নেই বলে উল্লেখ করে বলেন, সংযোগ না থাকলে পানি দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে যেখানে সংযোগ আছে সেখানে কেন পানি যাবে না তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। তিনি কথিত পানি ব্যবসার ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করে বলেন, এই ধরনের পানি ব্যবসা অবৈধ। অবশ্যই এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেমিকের সাথে ঝগড়া করে কিশোরীর আত্মহত্যা
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে হত্যা