বেশ কয়েক বছর পর ঘুরে দাঁড়ানো আবাসন খাত আবারো বড় ধরনের হোঁচট খেতে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, টাকার বিপরীতে ডলারের তেজিভাব, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিসহ দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা কারণে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সম্ভাবনার আবাসন সেক্টরে দুর্দিন এসেছে। ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ দ্রুত কমছে। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বিক্রি। অনেক আবাসন কোম্পানি নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। সবকিছু মিলে পুরো সেক্টরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সংকট। সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট ট্যাক্স ছাড় কিংবা বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা না হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটিকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা জানা যায়, আবাসত খাতে বার্ষিক কয়েক হাজার কোটি টাকার টার্নওভার রয়েছে। মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সম্ভাবনাময় খাতটি। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে রড-সিমেন্ট, পাথর, বালি, ক্যাবলসহ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বাড়ছে। এতে করে আবাসন সেক্টরের স্বাভাবিক প্রবাহ মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা ক্ষতির শঙ্কায় অনেক কোম্পানি নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছে। এতে অসংখ্য মানুষ ফ্ল্যাট কিনেও সময়মতো অ্যাপার্টমেন্ট বুঝে পাচ্ছেন না। পাশাপাশি পুরো সেক্টরটি ইমেজ সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অধিকাংশ ডেভেলপার কোম্পানি নির্মাণকাজ শুরু করার আগে রড-সিমেন্টসহ আনুষাঙ্গিক খরচ হিসাব করেন। প্রতি বর্গফুটে খরচ হিসাব করে তার ওপর লভ্যাংশ ধরে ফ্ল্যাটের দর নির্ধারণ করেন এবং ওই দরে বিক্রি করেন। উক্ত দরে কিস্তিতে ফ্ল্যাটের মূল্য আদায় করতে থাকেন। কোনো কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে কিংবা কমে গেলে উক্ত চুক্তির বাইরে কোনো অর্থ ডেভেলপার কোম্পানি দাবি করতে পারেন না। আদায় করারও সুযোগ নেই। অর্থাৎ কোনো ডেভেলপার কোম্পানি প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি করলে তার দাম আর বেশি দাবি করতে পারেন না। বর্তমানে যেসব ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে সেগুলো দুই-তিন বছর আগে বিক্রি করা ফ্ল্যাট। দুই- তিন বছর আগে নির্ধারিত দরের সাথে বর্তমানে নির্মাণ সামগ্রীর দাম ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। নির্মাণ সামগ্রীর এই মূল্যবৃদ্ধি ডেভেলপার কোম্পানিকে দিশেহারা করে তুলছে। বর্তমানে যেসব ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর দাম প্রতি বর্গফুটে ৭শ থেকে ৮শ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আগে বিক্রি হওয়া ফ্ল্যাটগুলোর ব্যাপারে করনীয় কী তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন রিহ্যাব জরুরি বৈঠকে বসবে।
এদিকে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পণ্যের দাম ৩৫-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে রড, সিমেন্ট, পাথর, বালি ও ক্যাবলের দাম বাড়ছে। রডের দাম রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকায় উঠেছে। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দেশে টনপ্রতি রডের দাম ছিল ৫৫ হাজার টাকা। একইভাবে ৩৮০-৪০০ টাকার এক বস্তা সিমেন্টের দাম এখন ৪৭০-৪৮৫ টাকা। বেড়েছে পাথর, বৈদ্যুতিক ক্যাবল, জিআই পাইপ, পিভিসি পাইপসহ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি জিনিসের দাম। ভেভেলপার কোম্পানিগুলো নির্মাণ সামগ্রীর যে দাম নির্ধারণ করেছিল তার চেয়ে নির্মাণ ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় তারা চোখে অন্ধকার দেখছে। নির্মাণ সামগ্রীর দাম যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে ফ্ল্যাটের মূল্যবৃদ্ধি না করলে কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়বে। কিন্তু যেসব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে সেগুলোর দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই, আবার কাজ বন্ধ করে দেয়ারও উপায় নেই।
কাজ বন্ধ করে দিলে আবাসন সেক্টর ইমেজ সংকটে পড়বে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে কিছু আবাসন কোম্পানির কারণে পুরো সেক্টরটি ইমেজ সংকটে পড়েছিল। নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেয়া, নিম্নমানের নির্মাণসহ চুক্তি লংঘনের কারণে আস্থার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি শীর্ষ আবাসন কোম্পানির কর্মকাণ্ডে পুরো সেক্টরের হারানো ঐতিহ্য ফিরতে শুরু করে। এখন কাজ বন্ধ করে দিতে হলে পুরো সেক্টরটি আবার ইমেজ ক্রাইসিসে পড়ে যাবে, যা সম্ভাবনাময় এই খাতটির বিকাশে অন্তরায় হবে। অপরদিকে ফ্ল্যাট বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেলে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আবাসন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে হলেও নির্মাণ সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। করোনাকালীন দুর্দিনে সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বল্পসুদের ওই ঋণ অনেক কোম্পানিকে খাদের কিনারা থেকে তুলে এনেছে। এখন আবাসন সেক্টরের জন্য বিশেষভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে এই খাতকে রক্ষা না করলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। তাই তারা সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বলে আজাদীকে জানান।












