একটা সম্পর্কে অনেক অনেক ভালো মুহূর্ত থাকে। সম্পর্ক–ই আমাদের সে–সুন্দর মুহূর্তগুলো দেয়। দুটো মানুষ পারস্পরিক পথ চলায় সময়কে নিংড়ে স্মৃতির সুগন্ধ জমা করে তাদের জীবনে। যেদিন থেকে সেই সম্পর্ক আর কোনো সুন্দর কিছু দিতে পারে না, তখনই তো সমাপ্তি ঘটে! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই হয়।
কিন্তু যে–ই না সম্পর্ক ভাঙলো, তার সাথে সাথে সমস্ত ‘ভালো‘র যেন মৃত্যু ঘটল। শুরু হয় কাদা ছোড়াছুড়ি! সুন্দরতম মুহূর্তগুলো, আনন্দের অভিজ্ঞতাগুলো, মূল্যবান স্মৃতিগুলো এক নিমিষেই হারিয়ে যায় অসুন্দরের পাঁকে। তখন শুধু গন্ধ ছড়ায়। গন্ধ আর গন্ধ। ভুলে যায় মানুষ হিসেবে মানুষকে সামান্যতম সম্মান দেওয়া তো যায়–ই। আর সে যদি হয় প্রাক্তন। মায়াও তো থাকবার কথা। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে টেনেহিঁচড়ে এমন নীচে নামায় যে, সুন্দরের দেখা আর মেলে না। সবই খারাপ। এর কাছে ওর কাছে তার বিষোদ্গার আর কুৎসা করাই একমাত্র ধর্ম হয়ে যায়।
সব মানুষের ভেতরই ভালো আর মন্দ থাকে। মানুষ সম্পর্কে মীমাংসায় আসা যায় না। মানুষ এবং তার চরিত্রপ্রকৃতি চিরকাল অমীমাংসিত। তেমনি সব সম্পর্কেও ভালো–মন্দ দিক আছে। দেখার বিষয়, সম্পর্ক ভেঙে গেলে আপনি কোনটা দেখতে চাইছেন। মন্দটুকুন নাকি ভালোটুকুন?
বর্তমান যুগে এক ক্লিকেই সব প্রমাণ রেখে দেওয়া যায়। প্রযুক্তি যেমন মানুষকে কাছে এনে দেয় তেমনি খুব দ্রুত ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়। কল রেকর্ড, স্ক্রিনশট, ভিডিও, স্থিরচিত্র সবই সময়ের ব্যবধানে সুন্দর মুহূর্ত থেকে অসুন্দরের কারণ হয়ে ওঠে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে ফেলে মানুষকে। একটা সুন্দর মুহূর্তকে ধারণ করে রাখা জিনিসটাই যেন অস্ত্রে পরিণত হয়। আর সে অস্ত্রের আঘাতটা সবসময়ই নারীদের দিকে তাক করা। সমাজে এমন এক অদ্ভুত আচার, যে, ভিডিও, ছবি বা কল রেকর্ড ভাইরাল হলেই নারীর চরিত্র গেল–গেল রব ওঠে। অথচ অপরপাশে পুরুষ সে–ঘটনার একটা কেন্দ্রীয় চরিত্র। পুরুষ অপরাধী হলেও আঙুলটা তার দিকে ওঠে না। এমন অসংখ্য ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা চারপাশে ঘটতে দেখা যায় নারীকে কেন্দ্র করে। শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় মব ট্রায়াল। যা নারীকে কিছু বলতে না দিয়েই উলঙ্গ করে দেয় ভরা মজলিশে। অনেকেই এই ফাঁদে পা দিয়ে হারিয়ে ফেলে মানসিক নিয়ন্ত্রণ। আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এসব ক্ষেত্রে করণীয় আসলে কী? মাথা ঠান্ডা রেখে লড়াই করা! লড়াই সহজ না হলেও সচেতনতা ও তথ্য কিন্তু সহযোগী হয়ে উঠতে পারে।
ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করলে ভুক্তভোগীর করণীয়
যদি কেউ কারও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন–২০২৩’ এবং ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন–২০১২’–এর বিভিন্ন ধারায় মামলা করার সুযোগ রয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন–২০২৩–এর ২৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে (ক) ইচ্ছাকৃত বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কোনো তথ্য–উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ–ধারা (১)-এর অধীন কোনো অপরাধ করেন, তাহলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ (তিন) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ ছাড়াও ২০১২ সালের ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন–২০১২’–এর ৮ (২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদা হানি করলে বা ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় বা অন্য কোনো সুবিধা আদায় বা কোনো ব্যক্তির জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ধারণ করা কোনো পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে মানসিক নির্যাতন করেন, তাহলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এমন অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
(৩) কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এমন অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
(৪) কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের মাধ্যমে ‘গণ উপদ্রব’ সৃষ্টি করলে সর্বোচ্চ ২ (দুই) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
(৫) (ক) কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি বিক্রি, ভাড়া, বিতরণ, সরবরাহ, প্রকাশ্যে প্রদর্শন বা যেকোনো প্রকারে প্রচার করলে অথবা উল্লিখিত সব বা যেকোনো উদ্দেশ্যে প্রস্তুত, উৎপাদন, পরিবহন বা সংরক্ষণ করলে সর্বোচ্চ ২ (দুই) বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
(৬) কোনো ব্যক্তি শিশুকে ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বিতরণ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অথবা শিশু পর্নোগ্রাফি বিক্রি, সরবরাহ বা প্রদর্শন অথবা কোনো শিশু পর্নোগ্রাফি বিজ্ঞাপন প্রচার করলে, সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
কীভাবে মামলা করবেন
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন–২০১২–এর ১০ ধারা অনুযায়ী, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য এবং ও জামিনযোগ্য। আমলযোগ্য ধারায় থানায় মামলা হলে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। যদি কোনো ব্যক্তি থানায় মামলা করতে যান এবং পুলিশ মামলা না নেয় তাহলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। আদালত মামলা গ্রহণ করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করলেই পুলিশ ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে।
জেনে রাখা ভালো, যদি কেউ মিথ্যা মামলা দেয় তবে তার শাস্তিরও বিধান আছে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি, কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ দায়েরের কোনো ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা বা অভিযোগ দায়ের করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এমন অপরাধী সর্বোচ্চ ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এই আইনের অধীন কোনো মামলায় আদালত যদি কোনো অভিযুক্তকে খালাস দেন এবং আদালত যদি এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ওই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও হয়রানিমূলক, তাহলে মামলা দায়েরকারী ব্যক্তি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এমন অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ২ (দুই) বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সর্বোপরি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সম্পর্ক পচনশীল। সেটাকে ফরমালিন দিয়েও বাঁচানো যায় না। সুন্দরের চর্চা মনকে আলোকিত করে। অথচ বেশিরভাগ মানুষ অপরকে শ্রদ্ধা করে না। এবং সম্পর্ককে সম্মানের সাথে লালন করে না। ফলে বিষময় পরিণতিতে শেষ হয়।
লেখক: শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী