বিশ শতকের ফটো জার্নালিস্ট ডরোথি ল্যাং

নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

১৯৩৬ সালের অভিবাসী এক মায়ের ছবি। মলিন। চিন্তার বলিরেখায় নতজানু চোখেরা এখনো উদ্বিগ্ন, তবে প্রকট হিসাব চলছে। মায়ের কাছে মুখ লুকালে পৃথিবী এখনো স্বর্গই। সেসন্তানেরা হয়তো তবু আঁচ করেছে, শিশু ভাইটির বিচ্ছিন্ন কান্না, ক্লান্ত ঘুম। এরমাঝে টুক করে এক্সপোজারকে দমিয়ে, বস্তুর উপর সমস্ত দায় দিয়ে, ক্ষুদ্র আলোতে একটি ছবি। এরপর আরো কিছু। ‘মাইগ্র্যান্ট মাদারস’ শীর্ষক ছবি যা ডরোথি ল্যাং তুলেছিলেন, ডজন খানেক ছবিকে পাশ কাটিয়ে।

আলোকচিত্র এমন এক মাধ্যম যা অবুঝ বালকের সাথেও সম্পর্কহীন এক সেতু তৈরি করতে পারে। অতীতের দলিল হিসেবে আলোকচিত্র সাক্ষ্য বহন করে নিঃসন্দেহে তবে সমকালীন সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, লিঙ্গ সমতা থেকে শুরু করে নানাবিধ জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের যেযাপন তা শতভাগ নিষ্ঠার সাথে আলোকচিত্র পালন করছে বলা যায়। এর মাঝে ফটোজার্নালিজমের যেঢেউ তা আলোকচিত্রকে সম্পূর্ণ একশ আশি ডিগ্রিতে ঘুরিয়ে আরো পাকাপোক্ত স্থান দিয়েছে।

 

স্টুডিও থেকে ঈষৎ রাস্তায় লেন্স ঘুরিয়ে, দারিদ্র্য মানুষের স্তব্ধ হয়ে আসা চিৎকার আলোকচিত্রে আনতেই ডরোথির পথ পরিবর্তন। ১৮৯৫ সালের ২৬ মেতে জন্ম নেওয়া ডরোথি ফটো জার্নালিজমের সেই ঢেউতে সার্ফিং করা এক অন্যতম যোদ্ধা। জীবনের প্রথম দিকে পোলিও আক্রান্তের স্মৃতি ডরোথির চলার পথের শক্তি হয়েছে, সে কখনোই তা অতিক্রম করতে চায়নি, বরং এই শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিল কেবল। কোথাও অনুপ্রবেশ না করেই, একজন ভালো অবজারভার হওয়ার শিক্ষাই আলোকচিত্রে ডরোথিকে স্বাগত জানিয়েছে।

ক্যামেরার মালিকানা ছাড়াই, তাকে নিজের অধীনে রাখা যায়। ক্যামেরা যেবাস্তবতাকে ধারণ করতে কুণ্ঠিত হয়, সেখানেই একজন আলোকচিত্রী সফলভাবে নিজের কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। ডরোথিও সে আগ্রাসনে, ছবি তোলা শুরু করলেও, প্রথম দিকের ছবিতে ছিল এক আভিজাত্য, তবে তা বেশিদিন টেকানো যায়নি। বিশ্বব্যাপী যে হাহাকার, বিষণ্নতা তাকে গ্রাস করেছিল, তা হয়তো জরুরি ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার রাস্তার হতাশায় ভরা মানুষদের আর্তনাদ আর যাই হোক স্টুডিওতে ধরা দেয় না। ডরোথি ‘পোর্ট্রেট’ ফটোগ্রাফারের চেয়ে ‘ফটো জার্নালিস্ট’ হিসেবে অনেক বেশি নিজেকে বিকশিত করেছেন, যদিও তাঁর বিখ্যাত কাজে বেশিরভাগেই ব্যক্তির একক প্রতিচ্ছবির দাপট দৃশ্যত।

হোয়াইট এঞ্জেল ব্রেডলাইন(১৯৩৩)’ ছবিতে ডরোথি দেখিয়েছেন, একাকীত্ব আর ক্ষুধার লড়াই। তাঁর ব্যক্তিক কৌশলগত ছবি সাবজেক্ট সম্পর্কে তথ্য দেয় সাথে সাবজেক্টের সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি পথও তৈরি করে। যেমনটা ‘মাইগ্রেন্ট মাদার’ ছবিতে ডরোথি বলছেন, তিনি কেবল এক ক্ষুধার্ত মায়ের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর জানা ছিল না, কীভাবে এই ক্যামেরা ছবির প্রেক্ষাপট তুলে আনবে, তবে এতটুকু মনে রেখেছেন, সে ক্ষুধার্ত মা ডরোথিকে কোনো প্রশ্ন করেননি।

ডরোথির ছবিতে শ্রমিক শ্রেণির দাবি স্পষ্ট ফুটে উঠে বলে, তা সমসাময়িক আন্দোলনে একটি অন্যতম টিকা হিসেবে কাজে দিয়েছিলো। আপোষ না করা ডরোথি দেশকাল ভেদে ছিল কেবল মানুষের। আমেরিকান ফটোজার্নালিস্ট তাই নিজের দেশীয় সংস্থার কাজ ছেড়েছেন জাপানীদের পক্ষে সত্যের লড়াইয়ের জন্যে। আমেরিকাতে জাপানীদের বন্দীশালার কভারেজ সমস্ত পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয়। জোরপূর্বক স্টেজড কাজের চেয়ে, ডরোথির মনোনিবেশ ছিল বাস্তবতাকে তুলে আনা। ফলে আমেরিকা কর্তৃপক্ষ ডরোথির কাজ বাজেয়াপ্ত করেন।

বিশ শতকের অন্যতম আলোকচিত্রী ডরোথি আধুনিক ফটোজার্নালিজমের এক নতুন রীতির সাথে আমাদের পরিচিত করায়। ডরোথির মতে এমন কোনো ছবি নেই যা শব্দের দ্বারা সুরক্ষিত করা যায় না। কেননা যদি ডরোথিকে এমন হাজার ছবির ভিড়ে একটি ছবির জন্যে মনে রাখতে হয় তবে তার ঐ হাজার শব্দের অন্তর্ভুক্তিও তাতে থাকবে। ডরোথি তাঁর ছবির তথাকথিত শিরোনাম দেননি বরং কান পেতে শুনেছেন সেছবির কবিতাটি, যেখানে হাজার উক্তি রয়েছে তাঁর সেই অনভূতি প্রকাশের জন্যে। যেমন, হাজারবার বলেছি আমরা ভালো আছি কিন্তু একবারও তো বলিনি, আমরা তাঁবুতে থাকি।

ডরোথির ছবি ক্লিকের পূর্বেই তাঁর সাবজেক্টের কথা বলেন, অন্যকে একশটা প্রশ্ন করার পূর্বে সে নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, এনেছেন উত্তর। ডরোথি সামাজিক ছবিকে ছাপিয়ে গেছে কেবল মানবিক ছবির উদ্দ্যেশে। এটা কতটা জটিল কিংবা সমীকরণ ভিত্তিক তা বোঝা যায় যখন সে বলেন, আলোকচিত্রী যে আলোকচিত্রী হয়ে ওঠেন এটা সিংহপোষমানানোকারী যে সিংহপোষমানানোকারী হয়ে ওঠেন তার চেয়ে দৈবতর কিছু নয়। (অনুবাদমাহমুদুল হোসেন)

ডরোথির ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন এন্ড দ্য নাইন্টি থার্টিজ ডাস্ট বোল’ কেবল ঐতিহাসিকভাবেই বিখ্যাত নয়, ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির এক নতুন জনরার সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। কেবল আবেগের ব্যবসায়িক লেনদেনের যে চিত্র তার থেকে বেরিয়ে মানবিকতার পক্ষে এছবিগুলো। ডরোথি ক্যামেরাকে কেবল যন্ত্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বলছেন, ক্যামেরা কেবল একটি যন্ত্র যা আমাদেরকে শেখায় কীভাবে ক্যামেরাকে ছাড়া দেখতে হবে।

ডরোথির কাজের তালিকায় আছে ‘অ্যা ভেরি ব্লু ঈগল’, ‘ড্যামেজড চাইল্ড’, ‘এক্স স্লেইভ ফ্রম লং মেমোরি’, ‘মাইগ্রেটরি কটন পিকার’, ‘চাইল্ড এন্ড হার মাদার’, ‘পিই পিকারস হোম’ প্রমুখ। সামাজিক জীবনে আলোকচিত্রের প্রতি শপথ ছিল, সেটি যাপন করে সারাজীবন পার করে আসা ডরোথি ১৯৬৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ সময়তেও ডরোথি সমসাময়িক আলোকচিত্রের সমালোচনায় নিখুঁত বিশ্লেষণ করেছেন। সাথে আহ্বান জানিয়েছেন মানুষের সাথে পুনঃসংযোগের। বলেছেন, বাস্তবতার চেয়ে মায়া নিয়ে বেশি চিন্তিত। কেননা পরিচিত পৃথিবী প্রায়শ অসন্তোষজনক হলেও অস্বীকার করা যায় না, এবং তা পরিত্যাগের মতোও নয়। তিনি আরো আশংকা করেন, বিশ্ব ভালো আলোকচিত্রী দিয়ে যেমন পূর্ণ তেমনই সেসকল আলোকচিত্রকে বিশ্বজুড়েও থাকতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্পর্ক যখন ব্ল্যাকমেইলের
পরবর্তী নিবন্ধহরতাল ও অবরোধবিরোধী সমাবেশ