বয়স্ক বা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়া বাবা-মাকে সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দিচ্ছে কেন? এটা কি এ সময়ের সমাজ বাস্তবতা? জন্মদাতা পিতা-মাতা সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কেন? আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ কি ক্রমেই অপসৃয়মান হচ্ছে? ভেঙে পড়ছে সম্পর্কের বন্ধনগুলো? যারা এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, তিলে তিলে নিজের সঞ্চয় শেষ করে বড় করেছেন যে সন্তানদের। একটু একটু করে খড়কুটো এনে যে ঘর বানিয়েছেন শেষ বয়সে সবাই মিলে থাকবেন বলে। আজ তাদেরই সে ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্যখানে আশ্রয় নিতে হয়। পুরোনো আসবাবের মতো একসময় অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন বৃদ্ধ বাবা-মা। তাই একসময় নিজের তৈরি ঘর ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে হয় তাদের। তাহলে কি এটাই এখনকার ট্র্যাডিশন হয়ে যাচ্ছে?
আভিধানিকভাবে বৃদ্ধ ও আশ্রম শব্দ দুটি মিলে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। অর্থ দাঁড়ায় বৃদ্ধনিবাস বা বৃদ্ধের আশ্রয়স্থল। শেষ সময়ের আবাসস্থল। বৃদ্ধাশ্রম হল বয়স্কদের থাকার জায়গা। অনেকটাই হোস্টেল এর মতো। যে সব বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দেখার কেউ নেই তাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল এই আবাসন। এখানে ঠিক সময়ে খাবার দেওয়া হয়। এখানেও হোস্টেলের মতো কমন রুম থাকে। আর এই কমন রুমে টিভি দেখার, বিকেলে পার্ক এ ঘোরানোর ব্যবস্থাও আছে। আজ সেই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কিছু লিখতে চাই। যতই বয়সের দিকে পা বাড়াচ্ছি, ততই একটা ভয় কাজ করছে। জীবনের শেষ সময়টা কীভাবে কাটবে আমাদের! এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে অনেকের সাথে কথা হয়েছে, অনেক জনের লেখায়ও পড়েছি ওনাদের কথা। এইসব পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই আমি যেন সেই মায়েদের কাছে বসেছি। গল্প করি, গল্প শুনি বাস্তবতার। তাদের দুঃখের ভার নেয়া সহজ নয়। সুখের সান্ত্বনাতেও আর বিশ্বাস নেই ওনাদের ।
যারা নিজেদের আরাম হারাম করে সন্তানদের মানুষ করেছেন, নিজের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য যে মা-বাবা ব্যাকুল থাকতেন, সে না খেলে থাকতেন অনাহারে, না ঘুমালে থাকতেন নির্ঘুম, অসুস্থ হলে বসে থাকতেন পাশে, যে বাবা-মা তিল তিল করে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানকে মানুষ করার জন্য, যে বাবা নিজের পকেট খরচকে বাঁচিয়ে রাখতেন তার সন্তানকে ভালো কিছু দিবেন বলে।
সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা যদি হয় বৃদ্ধাশ্রম, তবে তা মানবতার উপহাস বৈ কী? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গা দখল করে নিয়েছে শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থা। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থাও। কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ২৮.১০.১০১৮ তারিখে প্রকাশিত সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য মোতাবেক বর্তমান বাংলাদেশের নিবন্ধনকৃত শান্তি নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রমের) সংখ্যা ছয়টি। তথ্যমতে সারা দেশে প্রতিটি বৃদ্ধাশ্রমে ৫০টি করে মোট ৩০০টি সিট রয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আশ্রিত ব্যক্তিদের নিজস্ব অর্থায়নে চলে একটি আশ্রম ‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’ নামে। প্রায় ৩০/৪০ জন থাকতে পারে এখানে। চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায় কাপ্তাই সড়কের দক্ষিণ পাশে ২০১৪ সালের ১লা মে চালু হয় ‘আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। মানবতার উন্নয়নের আশায় কেন্দ্রটি চালু করেন শিল্পপতি শামসুল আলম। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের অবহেলিত, অসহায় প্রবীণদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিশিষ্ট শিল্পপতি মুকুল চৌধুরী ১৯৮৭ সালের গোড়ার দিকে ঢাকার উত্তরায় গড়ে তোলেন ‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটিকে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা হয় গাজীপুরের মণিপুর বিশিয়া কুড়িবাড়িতে। ১৯৯৫ সালে ২১ এপ্রিল শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির বর্ধিতাংশের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এখানে প্রবীণদের থাকার জন্য ১টি বিশাল টিনশেড ভবন ও ৩টি পাঁচতলা ভবন রয়েছে। যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রবীণ নিবাস হিসাবে বিবেচিত। কেন্দ্রটি ৭২ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হ’লেও বর্তমানে তা সমপ্রসারিত হয়ে ১০০ বিঘায় উন্নীত হয়েছে। মহিলা-পুরুষদের আলাদা ভবনে মোট ১২০০ মানুষ থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে এই কেন্দ্রে। বর্তমানে ২ শতাধিকের বেশি বৃদ্ধ সেখানে অবস্থান করছেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য রয়েছে চিকিৎসা কেন্দ্র। পরিবারের সন্তানদের বা পুত্রবধূদের সাথে অস্বাভাবিক অমিলের কারণে যেমন অনেকেই স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, তেমনি অনেকের ঠাঁই হয়েছে অনিচ্ছায়। যদিও সন্তান চায় সপরিবারে শান্তিতে বসবাস করতে। কিন্তু পুত্রবধূরা চায় সুখী সংসার নামের ক্ষুদ্র পরিবার গঠন করতে। অনেক সময় পিতা-মাতাও বৃদ্ধ বয়সের কারণে অস্বাভাবিক আচরণ করে। ফলে চরম বাদানুবাদের পরিসমাপ্তি ঘটে বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধের ঠাঁই করে দিয়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার অবস্থান গড়তে হয় বৃদ্ধাশ্রমে।
প্রযুক্তির কারণে দেখা বা শোনা যায় এমন অনেক কথা। অনেক সন্তান ডাক্তার দেখানোর কথা বলে এখানে দিয়ে যায় বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে। সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা তখনই ঘটে যখন নিজের পুত্র বা পুত্রবধূ আশ্রমে রাখার সকল কার্যক্রম শেষ করে ঔষধ আনার নাম করে কৌশলে পালিয়ে যায়। তার হৃদয়ফাটা কান্না আর আহাজারি যেন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হ’তে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় পরিবারের সদস্যদের বনিবনার অভাবেই এ কাজ করেছে।
এখানে যারা আছেন তাদের অপেক্ষা থাকে, তাদের চাওয়া পাওয়া, হিসেবনিকেশ, মানঅভিমান সবই থাকে। একটা সময়ে অভিমানে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ একদিন সবকিছু থেকে সরে যায়। তার আর কোনো গল্প থাকে না, ফিরে যাওয়া হয় না প্রতিচ্ছবির কাছে। ডুবে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি যেন ধুলোর আস্তরে ঢেকে যায়। ঢেকে রাখে চোরাবালিতে। এখানে স্বামী- স্ত্রী যারা একসাথে আছেন, ঘুমনোটা হয়তো একসাথে তাদের আর হয় না। দীর্ঘ বছরের এক সাথের রাত্রিযাপন, পাশে থাকার রাতের নির্জনতার কত গল্প যে তাদের জমা থাকে শেষ বয়সে এসে এটা থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। আপন স্বার্থ বড়ো করে দেখার সুযোগ আর থাকে না। ভাবতে খুব কষ্ট হয়। একবার যে ঘর ভাঙলো, একবার যে ঘরছাড়া হলো সে ঘর আর জোড়া লাগে না। একটু স্পর্শ যে কতটা প্রয়োজন এই শেষ বয়সে তা একমাত্র তারাই বুঝবেন যে সঙ্গীছাড়া হয়েছেন। এখানে কেবল নিয়মমাফিক জীবনঘেরা চারপাশ।
বৃদ্ধাশ্রমে আছে অনেক কিছুই, তবু যেন কিছু্ই নেই সেখানে। সবার ভিতরে শুধু হাহাকার পরিবারের সদস্যদের এক নজর দেখার জন্য। কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে হয়ে গেছে বোবার মতন। আবার কারো মুখে বিলাপ জড়িত কণ্ঠে প্রশ্নের আহাজারী। ঝড় উঠলে সংকেত দিয়ে জানানো হয় কত বেগে ঝড় বইছে। কিন্তু সন্তানের কথা বা পরিবারের কথা মনে হ’লে ভিতরে যে ঝড় বয়ে যায় তার গতিবেগ হিসাব করে বের করা দুঃসাধ্যই বটে। মনের অজান্তে চোখের ঝাপসায় মিলিয়ে যায় বৃদ্ধাশ্রম।
একটা সময়ে এই বাবা-মা সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য নিজের সহায় সম্বল বিসর্জন দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে আশায় বাঁচে। তার সন্তান ভালোভাবে বাঁচতে পারবে নিশ্চিতভাবে। সন্তান ঠিকই ভালোভাবে বাঁচে কিন্তু তার পরিবার কীভাবে জীবনযাপন করছেন তা জানার বোধটুকুও তার আর থাকে না। প্রতিদিন হাঁটার পথে এমন মায়েদের কথা শুনি। তাদের ভিতরের আর্তনাদে শুকনো পাতায় পা পড়লে যে মর্মর শব্দ হয় ঠিক ভেতরটা অমনি করে ওঠে। আর আমার তখন নচিকেতার গানটা খুব মনে পড়ে। ‘নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী, সবচে’ কমদামী ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’।
অজান্তেই নিজের চোখ বেয়েও জল নামে। আমি মুখ লুকিয়ে চোখ মুছে নিই আকাশপানে চেয়ে। যে হারে পিতামাতার প্রতি সন্তানের তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখা যায় অচিরেই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়বে। আমার অনুরোধ রইল সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশের মতো করে যেন থাকার উপযোগী বৃদ্ধাশ্রম হয়। আনন্দ নিয়েই যেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পারে।
লেখক : উপদেষ্টা, নারীকণ্ঠ