সম্পত্তি সরকারি, আয় ‘বেসরকারি’!

জিইএম প্লান্টের ৮ একর পুকুর জলাশয় ইজারার আয় নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

সম্পত্তি সরকারি, কিন্তু এর আয়ের টাকা কোষাগারে জমা না দিয়ে ভোগ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ‘জিইএম প্লান্ট’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের (বিএসইসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জেনারেল ইলেক্ট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির প্রায় ৮ একর পুকুর জলাশয় ইজারা দিয়ে কোটি কোটি টাকা ভাগ ভাটোয়ারার ঘটনা ঘটছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জিইএম প্লান্টটি সিডিএ’র নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে লাগোয়া হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ৮ একর জমির মূল্য বর্তমানে শত কোটি টাকার উপরে দাঁড়াবে। অভিযোগ রয়েছে, নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত জিইএম প্লান্ট দীর্ঘদিন থেকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এখনো অপারেশনাল লোকসান হয়ে আসলেও নন অপারেটিং ইনকাম হিসেবে ব্যাংক সুদ দিয়েই সরকারকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুখ দেখাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।
বিষয়টি জানতে জিইএম প্লান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলামের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তার ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল দুই মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি কোন সাড়া দেননি। জানা যায়, জিইএম প্লান্টের মোট ৫ কানি (দুই একর) আয়তনের তিনটি পুকুর ও প্রায় ১৫ কানি (৬ একর) আয়তনের ১৫টি জলাশয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইজারা না দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সংগঠন জিইএম প্লান্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে লাগিয়ত করে আয়ের টাকা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। পুকুর জলাশয় ইজারা থেকে ভাগের টাকা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও সমানভাবে ভোগ করে থাকেন। দীর্ঘ বছর ধরে সিবিএ নেতারাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে সরকারি সম্পদের আয় তসরূপ করে চলেছেন।
জিইএম প্ল্যান্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিদ্যুৎ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৬৫ সালে জিইএম প্লান্টের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। রাশিয়ার ‘প্রমাশ এঙপোর্ট’ এর কারিগরি সহায়তায় নগরীর উত্তর পতেঙ্গায় ১২২ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয় প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৭ সালের ১৪ জুলাই থেকে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। শুরু থেকে সুনাম অর্জন করলেও নানা অনিয়মে দিন দিন হ্রাস পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনশীলতা। প্রতিষ্ঠানটি মূলত পাওয়ার ট্রান্সফরমার, সার্কিট ব্রেকার, আইসোলেটর, লাইটেনিং এরেস্টার এবং সুইচ গিয়ার নির্মাণ করে আসছে। নানা অনিয়মের কারণে অর্ডার কমতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় দেড় হাজার যন্ত্রপাতির ৮০ শতাংশই অচল হয়ে পড়েছে। কিছু মেশিন আছে, গত ১৫-১৬ বছরেও ব্যবহৃত হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৮ একরের অধিক পুকুর জলাশয় ইজারার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেই। তাঁর সহযোগিতায় কো-অপারেটিভ সোসাইটি শত কোটি টাকার পুকুর জলাশয় ইজারা দেয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
এসব পুকুর জলাশয়ের সম্পর্কে জানতে উর্ধতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাসেরের মুঠোফোনে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, পুকুর ও জলাশয়ের বিষয়টি কো-অপারেটিভ দেখভাল করে। তিনি প্রতিবেদককে প্রতিষ্ঠানের কো-অপারেটিভ সোসাইটির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার অনুরোধ করে আর কোন তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বিএসইসিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ২০০৬-০৭ সালের দিকে জিইএম প্লান্টে পদায়িত হন। এরপর পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। ইতোমধ্যে জিইএম প্লান্টের বেশিরভাগ কর্মকর্তা বিএসইসির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বদলি হলেও আশরাফুল আলম ১৫ বছরের মতো জিইএম প্লান্টে রয়েছেন। পুকুর জলাশয়গুলোতে মাছ চাষ করে বছরে ২০-২৫ লক্ষ টাকা আয় হয়। কোন দরপত্র আহবান করা হয় না। তাই বাইরের কেউ এসব পুকুর ইজারা নিতে পারেন না। জিইএম প্লান্টের লোকজন পুকুরগুলোতে মাছচাষ করেন। আয়ের টাকাও তারা ভাগ করেন।’
এ ব্যাপারে জিইএম প্লান্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটির সভাপতি গোলাম মাওলা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘শুধু বর্ষাকালে জলাশয়গুলোতে পানি থাকে। শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। জলাশয়গুলোতে বর্ষাকালে মাছ চাষ হয়, শুষ্ক মৌসুমে হয় ঘাস।’ পুকুর তিনটির আয়তন প্রায় তিন কানি (প্রতিকানিতে ৪০ শতক) এবং জলাশয়গুলোর আয়তন ১২ কানির মতো দাবি করে তিনি বলেন, ‘পুকুর তিন বছরের জন্য, এবং জলাশয়গুলো দুই বছরের জন্য কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে উন্মুক্ত টেন্ডারে লাগিয়ত করা হয়। টেন্ডারে সমিতির সদস্যরা অংশ গ্রহণ করেন। যার দর বেশি উঠে তাদের আলাদা আলাদাভাবে ইজারা দেয়া হয়। । গতবার পুকুরগুলো প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা এবং জলাশয়গুলো প্রায় ৫ লক্ষ টাকা লাগিয়ত করা হয়েছে। ইজারার টাকা কো-অপারেটিভের সদস্যদের মধ্যে সমানহারে ভাগ করে দেয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘আগে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী সিবিএ নেতারা এসব পুকুর জলাশয় লুটপাট করে খেতো। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর কোন টাকাই তসরূপ হয়নি। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সদস্যদের সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হয়। সমিতিতে ৮৮ জন সদস্য রয়েছেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে সুইপার সব সদস্যই সমান অংশের অধিকারী।’ তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুকুর জলাশয় লাগিয়তের আয় থেকে প্রত্যেক সদস্য ১৮ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকও পেয়েছেন ১৮ হাজার টাকা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, জিইএম প্লান্ট একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি মানে সরকারি সম্পদ তথা দেশের ১৮ কোটি মানুষের সম্পদ। কিন্তু জিইএম প্লান্টের কর্মকর্তারা এসব সম্পত্তি নিজেদের মনে করছে বিধায়, প্রতিষ্ঠানের পুকুর লিজের টাকা তারা নিজেরা আত্মসাৎ করছেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যবহার। এখানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সকলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি টাকা নিজেরা নয়ছয় করেছেন। এসব অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এ বিষয়ে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান মো. শহীদুল হক ভূঁঞা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জিইএম প্লান্টের পুকুর জলাশয় হলো সরকারি সম্পত্তি, কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সরকারি সম্পত্তি থেকে আয় কেউ ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতে পারে না। আমি চট্টগ্রামে আসবো। এ ধরনের ঘটনার সত্যতা পেলে প্রশাসনিক অ্যাকশনে যাবো।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরকিয়ায় বাধা দেয়ায় স্বামীকে রশি বেঁধে নির্যাতন
পরবর্তী নিবন্ধরেলের ১৯শ’ অস্থায়ী গেটকিপার পায়নি ৪ মাসের বেতন-বোনাস