বিশ্বের সকল সচেতন মহল সম্যক অবগত আছেন, করোনা অতিক্রান্তির দুঃসময়ে প্রায় প্রতিটি দেশই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী। প্রায় স্তিমিত; কিন্তু ভিন্ন প্রকরণে করোনা আক্রমণ বহুদেশে চলমান। নির্দয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন করে পুরো বিশ্বকে অতিশয় পর্যুদস্ত করে চলছে। ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক মহামন্দা নিয়ে নানামুখী সম্ভাব্য সংকট যারপরনাই জনমনে আতঙ্ক–আশঙ্কা বিরাজিত। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের বিশ্বস্বীকৃত উন্নয়ন–অর্জন ইতিমধ্যেই বিস্ময়কর অধ্যায় রচনা করেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ‘বৈশ্বিক সংকটের বড় ধাক্কা নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিশ্বের জ্বালানি বাজারে অস্থিরতার কারণে দেশটিতে গৃহস্থালি কিংবা শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে উঠেছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলছে এবং তা আরো বাড়তে পারে। সরকার
অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জ্বালানি উচ্চমূল্যের কারণে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে লোডশেডিং দিচ্ছে, কারখানা খোলা রাখার সময় কমিয়েছে, বিলাসপণ্য ক্রয় কঠিন করে তুলছে। এর সব কিছুই করা হয়েছে ডলার সাশ্রয়ে।’ ১০ জানুয়ারি ২০২৩ প্রকাশিত গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভুটানে বিশ্বব্যাংকের নতুন কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন,
দারিদ্র্যের হার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে তিনি ‘সত্যিকারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন।
২৬ জানুয়ারি ২০২৩ গণমাধ্যমে প্রকাশিত জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের
ভূমিকায় সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও অনিশ্চয়তা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বিস্তৃত পরিসরে বড় ধরনের মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।’ প্রতিবেদন মতে, ২০২২ সালে বিশ্বের ৩ শতাংশের প্রবৃদ্ধির বিপরীতে এ বছর নেমে আসতে পারে ১ দশমিক ৯ শতাংশে যা হবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্জিত সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধির হারগুলোর মধ্যে একটি। যদি বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসে এবং
অর্থনীতির উন্নয়নের বাধাগুলো দূর হতে থাকে, তাহলে ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির দেশের প্রবৃদ্ধির গতি দুর্বল হয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব বিশ্বের বাকি
দেশগুলোয় পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরে মাত্র দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে, গত বছর যা ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ইইউতে গত বছরের ৩ দশমিক ৩ শতাংশের প্রবৃদ্ধি চলতি বছরে নামতে পারে ২ শতাংশে এবং যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে যা হতে পারে দশমিক ৮ শতাংশ। ইউরোপের অনেক দেশে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ একটি হালকা মন্দাবস্থাও দেখা দিতে পারে। এছাড়াও প্রতিবেদনে ক্রমহ্রাসমান চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। শূন্য কোভিড
নীতি ত্যাগের কারণে দেশটির অর্থনীতি ভালো হচ্ছে বিধায় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালের ৩ শতাংশের বিপরীতে এ বছরে ৪ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছুতে পারে।
২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান শঙ্কার বিষয় মূল্যস্ফীতি এখনও সর্বাধিক আলোচিত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোসহ বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির রেকর্ড উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে। কয়েক মাস পূর্বে করা আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি হতে পারে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২২ সালের এডিবির মূল প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি সম্পূরক প্রতিবেদনে বৃদ্ধি করা হয়েছে। মূলত বাংলাদেশ, নেপাল,
পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকতায় দেশের বিশিষ্ট অর্থ–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কিছু নেই। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু উদ্বেগের জায়গা হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। প্রবৃদ্ধি যা হচ্ছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তার সুফল সিংহভাগ মানুষ পাচ্ছে না।
অর্থাৎ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না।’ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত সূত্রমতে, বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে কমছে মূল্যস্ফীতি। বছরের শুরুর মাসেও মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর আগের মাস ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। টানা পাঁচ মাস নিম্নমুখী দেশের মূল্যস্ফীতি।
৩ আগস্ট ২০২২ গণমাধ্যম সূত্রে, করোনা মহামারি পরবর্তী রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারসহ বিভিন্ন সংকট কাটিয়ে অর্থনীতির ইতিবাচক
ধারায় দেশ পরিচালিত করছে বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন। থাইল্যান্ডের ব্যাংকক পোস্টের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে ভারতের কর্ণাটকভিত্তিক গবেষক ও বিশ্লেষক জন রোজারিও বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার মতো সংকট হবে না বাংলাদেশের। ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্ট প্রকাশিত সম্প্রতি ঋণ ঝুঁকিতে থাকা ২৫টি দেশের তালিকায় রাশিয়া, জাম্বিয়া, সুরিনেম, লেবাননসহ কয়েকটি
দেশ ইতিমধ্যে ঋণ পরিশোধে পিছিয়ে আছে। অপর দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন, তিউনেশিয়া, ঘানা, মিসর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, এল সালভাদর, পাকিস্তান, বেলারুশ ও ইকুয়েডর রয়েছে মূল্যস্ফীতি–ঋণ–উচ্চ ঋণের ব্যয়ের তালিকায়। দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বেলারুশ। এই তালিকায় নেই বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও গতিশীল নেতৃত্বে অর্থনীতিকে সমান গতিতে রাখার প্রায়োগিক পদক্ষেপ সর্বত্রই সমাদৃত।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে নেয়া হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিত করা, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমানো, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সে নগদ প্রণোদনা দেওয়া, বিলাসবহুল পণ্যে করারোপ করার মতো কার্যকর উদ্যোগ। যাতে আমদানির চাহিদা সহজে মেটানো যায়। এরই মধ্যে সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রপ্তানি বৃদ্ধি এবং আমদানি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত ডিপ্লোমেটিক এডিটর দীপরঞ্জন রায় চৌধুরীর মতানুসারে, বৈশ্বিক মন্দাতেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগছে সারা বিশ্ব। যার প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার
দেশগুলোতে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উদ্বেগজনকভাবে কমেছে পাকিস্তানেও। এমন আঞ্চলিক ভূ–অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও নিজেদের অর্থনীতি স্থিতিশীল রেখেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর সময়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সফল ও সার্থক হয়েছে এই জাতিরাষ্ট্র। বিস্তৃত উৎপাদন খাত এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন; সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার মধ্যে অনুসরণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর
বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র মতো নিন্দনীয় উক্তির বিষয় তুলে ধরে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তার প্রমাণ হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া পদ্মা সেতু। যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সেতুর অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল; তারাই এখন বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এই সেতুর কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক শক্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ নিজেই উন্নয়নের একটি রোডম্যাপ দিয়েছে। ভিশন–২০৪১ নামের এই রোডম্যাপের লক্ষ্য ২০৩১ সালের মধ্যে
প্রকট দারিদ্র্যের অবসান এবং উচ্চ–মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও অগ্রগতি অর্জন করছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে পাকিস্তানের দ্যা এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিখুন। তিনি বাংলাদেশের গর্ব।
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আইএমএফ–এর হিসেব অনুযায়ী পিপিপি’র ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ৩০তম। প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস এর প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে ২০৪০ সাল নাগাদ
বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে ২৩তম স্থান দখল করবে। এইচ.বি.এস.সি ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। বিশ্বব্যবস্থার সামগ্রিক সংকট মোকাবেলায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের প্রজ্ঞা–মেধা–দূরদর্শী চিন্তাচেতনায় পরিশীলিত পরিকল্পনা শুধু
বাচনিক অর্থে নয়; প্রায়োগিক পন্থা অনুসরণে কার্যকর কর্মকৌশলও দৃশ্যমান। দেশপ্রেম–সততা–আন্তরিকতা ও নিষ্ঠতায় নির্ভার হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের সমাহার দেশ ও জনগণের কল্যাণে পরিপূর্ণ নিবেদিত থাকুক – এটিই প্রত্যাশিত।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।