আমদানিকৃত তরল জ্বালানি খালাসে ব্যয় ও সময় বাঁচানোর লক্ষ্যে বাস্তবায়নাধীন বিপিসির প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) প্রকল্পের ১৩৫ কিলোমিটার পাইপলাইন সমুদ্রের তলদেশে বসানো সম্পন্ন হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রকল্পটির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আমদানিকৃত ক্রুড ও পরিশোধিত জ্বালানি খালাসে বিপিসির বছরে অন্তত ৮শ কোটি টাকার খরচ সাশ্রয় হবে। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে ইআরএলের মাধ্যমে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিপিসি। কিন্তু নানা জটিলতার মুখে সময়ক্ষেপণের কারণে ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যায়। ধারাবাহিকতায় একাধিকবার সংশোধিত হয়ে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (সিপিপিইসিএল) সাথে চুক্তি করে বিপিসি। প্রায় দেড় বছর পর ২০১৮ সালের ১৪ মে থেকে কাজ শুরু করেন ঠিকাদার।
এদিকে কাজ শুরু হলে গত বছরের ৬ জুলাই আরও এক দফায় সংশোধিত হয়ে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা বাড়ে। পরবর্তীতে মাতারবাড়ী চ্যানেলকে ঝুঁকিমুক্ত করতে আরও ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে বসানোর কাজও শেষ করেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াবে ৬ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা যায়, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) বর্তমানে ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) পরিশোধন ক্ষমতা বার্ষিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন। ইআরএল ইউনিট-টু প্রকল্প চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা প্রতি বছর ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য বছরে ৫০ লাখ মেট্রিকটন ডিজেল আমদানি করে বিপিসি। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা ৮ মিটার থেকে ১৪ মিটারের নিচে হওয়ায় অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে ক্রুড অয়েলবাহী বড় ভ্যাসেল হ্যান্ডেল করতে পারে না চট্টগ্রাম বন্দর। যে কারণে ক্রুড অয়েলবাহী মাদার ভ্যাসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করা হয়। মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজে করে ক্রুড আনলোডিং করা হয়। লাইটারেজ অপারেশনের মাধ্যমে ক্রুড আনলোড করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। আমদানিকৃত জ্বালানি খালাসে ব্যয় ও সময় বাঁচানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়াতে এসপিএমসহ পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি প্রকল্পটির আওতায় মহেশখালীর মাতারবাড়ী উপকূলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাংক এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হচ্ছে। মহেশখালীতে তৈরি করা হচ্ছে পাম্প স্টেশন, স্কাডা সিস্টেম এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। নির্মাণ করা হচ্ছে দুটি সংযোগ সড়কও।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত আজাদীকে বলেন, সাগরের তলে পাইপলাইন বসানোর কাজ করেছে বিশেষায়িত কার্গো বার্জ হাইলং ১০৬। অন্যদিকে এসব পাইপলাইনকে সমুদ্রের তলদেশের ৬-৭ ফুট গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে আরেক কার্গো বার্জ রেজিলিয়্যান্ট। এছাড়া পরিকল্পনাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ও বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ী কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট সংলগ্ন মাতারবাড়ী চ্যানেলকে ঝুঁকিমুক্ত করতে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাইপলাইন সাগরের ৩০ ফুট গভীরে বসানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অফশোরে (সমুদ্রে) ১৩৫ কিলোমিটারসহ মোট ১৯০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো শেষ হয়েছে। গত ৩০ মে অফশোরের সম্পূর্ণ পাইপলাইন বসানো সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ট্যাংক ফার্মের কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ কিছুটা বিলম্বিত হলেও এখন পুরোদমে চলছে। কিছু স্থানে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা রয়েছে। এসব জটিলতা কেটে গেলে দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।