অবক্ষয় আজ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে, এর থেকে বেরিয়ে আসার কোন প্রবণতাও তেমন করে চোখে পড়েনা। যা কিছু দৃশ্যমান, তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।
এই অবক্ষয়ের কালো থাবা থেকে ধর্ম-সমাজ-বিজ্ঞান- রাজনীতি কোন কিছুই মুক্তি পায়নি। আজ সারা পৃথিবীতে অধিকাংশ তীর্থস্থান ধর্মের ছদ্মবেশে এক একটা প্রতারণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মুখে মুখে ধর্মের বুলি ছড়ানো হচ্ছে আর গোপনে গোপনে নিজেদের আয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। একশ্রেণির মানুষ ধর্মস্থানকে হাতিয়ার করে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে উঠেছে। হেন কোন কুকর্ম নেই যা তারা করছে না।
এখন ধর্মকে রাজনীতির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। উত্তরোত্তর উপাসনালয়ের সংখ্যা বাড়ছে আর একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীরা সহজ-সরল ধর্মভীরু মানুষদের ঠকিয়ে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সফল করছে। নিজেদের পুঁজিবৃদ্ধি করছে।
প্রকৃতধর্ম মানুষকে মনের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করে। তাকে সততা আর মানবতার শিক্ষা দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে অসৎ ধর্মব্যবসায়ীর কবলে পড়ে ধর্মই লাঞ্ছিত হচ্ছে। অপমানিত হচ্ছে ধর্মের অমিয় বাণী। তথাকথিত ধার্মিকদের মুখ ও মুখোশের কবলে পড়ে ভুলুন্ঠিত হচ্ছে ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
বিজ্ঞানও আজ অপব্যবহারের শিকার মানবজাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে যে বিজ্ঞানের জন্ম তা আজ অনেক ক্ষেত্রে মানবকূল ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আজকালকার মানুষের জীবনচর্চা যেমন উন্নত হয়েছে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে তার অপপ্রয়োগে অনেকের জীবনে অন্ধকারও ঘনিয়েছে।
সূচনালগ্নে বিজ্ঞান মানুষের বন্ধু হয়ে এসেছিল। যোগাযোগ, আমোদ-প্রমোদ, প্রতিদিনের ব্যবহার্য সামগ্রী… সবকিছুতেই বিজ্ঞান তার উন্নতির হাত বাড়িয়েছে। কম্পিউটার মানুষকে অগ্রগতির চরমশিখরে নিয়ে গেছে। প্রায় মানুষের মত কর্মক্ষম রোবট এই পৃথিবীটাকে করেছে বিস্ময়কর! জেনেটিক কোডের হেরফের করে উচ্চফলনশীল শস্যের বীজ আবিষ্কার কৃষিতে এনেছে ব্যাপক বিপ্লব। চিকিৎসাকে বিস্ময়কর উন্নতির পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিজ্ঞান মানুষের জীবনীশক্তিকে করেছে বৃদ্ধি। আরো কত শত বিষয়ের উন্নয়নে যে বিজ্ঞানের ছোঁয়া লেগেছে তা বলাই বাহুল্য!
কিন্তু লোভ যখন মানুষকে বিপথে চালিত করে তখন তা হয় ভয়ংকর! সৃষ্টির বদলে তা নিয়ে আসে ধ্বংস। একসময় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতো প্রকৃতি। কিন্তু একসময় মানুষ এবং তার সীমাহীন লোভ প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। সে পাহাড় কেটে তার উপরে বসতবাড়ি নির্মাণ করা শুরু করলো, বৃক্ষনিধন করে নগর চত্বর গড়লো। এতে বিপর্যস্ত হলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ফলে ঘনিয়ে আসলো নানা বিপর্যয়।
এভাবেই বিভিন্নভাবে মানুষের লোভ আর অপরাধ বিজ্ঞানকে অপপ্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির মত বিজ্ঞানের আশীর্বাদও আজ মানুষের অপব্যবহারের ফলে ক্ষেত্রবিশেষে জীবনের অভিশাপরূপে পরিগণিত হচ্ছে।
সমাজজীবনও আজ নানা ক্লেদাক্ততার শিকার। নানাপ্রকার দূষণ আর ব্যাভিচারে সমাজ আজ বিপর্যস্ত। সততা, মানবতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, পরোহিতকারিতার মত সৎ গুণগুলো আজ যেন অবলুপ্ত। ব্যক্তিস্বার্থ, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, লোভলালসার সীমাহীন বিস্তার মানুষকে মনুষ্যত্বের মূলমন্ত্র থেকে সরিয়ে এনেছে অনেকটা। আজকাল সামাজিক-পারিবারিক বন্ধন বেশ শিথিল। ধৈর্য, সহ্য, সম্মান, সহবৎ এসব গুণাবলী সমাজ থেকে আজ নির্বাসনে। শোষণ, শ্রেণিবৈষম্য এসব এখন অতিসাধারণ বিষয়। সমাজের একটা শ্রেণি নানাভাবে ধনকুবের হয়ে চলেছে, আবার তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আরেক শ্রেণি হয়ে চলেছে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর! সামপ্রতিককালের রাজনৈতিক অবক্ষয়ও সমাজজীবনকে করে তুলছে বিষময়। রাজনীতি এখন সমাজবদলের হাতিয়ার নয়, এটা এখন নিজেদের সম্পদ গড়ার হাতিয়ার। অত্যন্ত লাভজনক এক ব্যবসার রূপ নিয়েছে এখনকার রাজনীতি। দুর্নীতি, চৌর্যবৃত্তি, হিংস্রতা একে করে তুলেছে বদ্ধ জলাশয়ের এক দুর্গন্ধময় পীঠস্থান যেন! দেশের উন্নয়ন নয়, ভোগবিলাস আর নিজেদের সুখসম্পদ বৃদ্ধিতে নেতারা আজ মশগুল! রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে তারা যে কোন হীনকাজ করতে তারা পিছপা হন না। আজকের রাজনীতি তার আদর্শ হারিয়েছে, মুছে ফেলেছে তার স্বর্ণালি অতীত। জনসমর্থন নয় দুর্বৃত্তায়নই আজকের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। মানবতাহীন, দেশপ্রেমহীন, আদর্শহীন, স্বার্থসর্বস্ব লোলুপ রাজনীতির কবলে পড়ে আজ দেশের মানুষও যেন এক দিশাহীন পথের যাত্রী! ধর্ম-বিজ্ঞান-সমাজ ও রাজনীতির অবক্ষয়ের যাঁতাকলে পড়ে আমাদের সুন্দর এক দেশ গড়ার যে স্বপ্ন এখন বিলুপ্তপ্রায় তার থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে আমাদের সমাজের অবশিষ্ট সৎমানুষদেরকেই। তাই তাঁদের হাতেই তুলে দিলাম আমাদের জিয়নকাঠি।
লেখক : প্রাবন্ধিক