সমকালের দর্পণ

ফিলিস্তিনে গণহত্যা - বুশনেলের আত্মাহুতি

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১০ মার্চ, ২০২৪ at ৯:১২ পূর্বাহ্ণ

১৯১৪ সালের নভেম্বরে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বৃটিশরা। সেই সাথে বৃটিশ যুদ্ধকালীন মন্ত্রী সভা ফিলিস্তিন নিয়ে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটায়। যুদ্ধ শুরুর দুই মাসের মধ্যেই বৃটিশ মন্ত্রী সভার ইহুদিবাদী মন্ত্রী হের্ভাট স্যামুয়েল ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। হের্ভাট যুক্তি দেখান এটা করা হলে যুদ্ধে বৃটেন ইহুদিদের ব্যাপক সমর্থন পাবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী এসকুইথ যুদ্ধ পরবর্তী ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখতে ১৫ এপ্রিল ১৯১৭ সালে একটি কমিটি গঠন করেন। এরই ফলশ্রুতি পরবর্তী বিষবৃক্ষ “বালফোর ডিক্লারেশন” এবং এই ডিক্লারেশনের ফল ইসরাইল। সেইসব ষড়যন্ত্র আর বিষবৃক্ষের বিষয়ে আমার পরবর্তী লেখায় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার আশা রাখি। ইতিমধ্যে সুয়েজ খাল দিয়ে বহু পানি গড়িয়েছে। সত্তর বছরেরও অধিক সময় ধরে বৃটিশদের লাগানো সেই বিষবৃক্ষের বিষফলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে ফিলিস্তিনের মানুষ। ফলশ্‌্রুতিতে গাজায় গঠিত হয় চরমপহ্নী দল হামাস। হামাস ৭ অক্টোবর ২০২৩ ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে জীবনঘাতি এক দুর্ধর্ষ অভিযান পরিচালনা করে। এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বিগত প্রায় পাঁচ মাস যাবত ইসরাইল গাজায় আন্তর্জাতিক মহলকে উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক সমস্ত রীতিনীতি ভঙ্গ করে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

গাজা তথা সমগ্র ফিলিস্তিন জুড়ে এখন ইসরাইলীদের দ্বারা নির্বিচার বোমাবর্ষণ চলছে। চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ মানুষগুলোর উপর জল স্থল আর আকাশ থেকে আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে এ হামলার শিকার হয়ে মানুষের বাড়ী ঘর বিরাণভূমিতে পরিনণ হয়েছে। এ পর্যন্ত নারী শিশু সহ ৩০০০০(ত্রিশ হাজার) এর বেশী মানুষ নিহত হয়েছেন। ধ্বংস স্ত্তূপের নীচে চাপা পড়ে আছে আরো হাজার হাজার মানুষ। হাসপাতাল আক্রান্ত এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা চুড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত। গাজার কয়েক লক্ষ পরিবার স্বীয় আবাসস্থল ছেড়ে আশ্রয়ার্থে অন্যত্র নিরাশ্রয়। জাতিসংঘ প্রেরিত ৭০ শতাংশেরও বেশী ত্রাণ ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ আটকে দিচ্ছে। হাসপাতালে প্রসূতি মায়েরা সংকটকালীন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না।

ইসরাইলী দায়িত্বশীল নেতারা ফিলিস্তিনীদের পশুর সাথে তুলনা করে তাদের সৈন্যদের অবাধ নিরীহ নারী পুরুষ শিশুদের হত্যায় ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছেন। পশ্চিমা বিশ্বের নেতারাও ইসরাইলী নেতাদের এ ইন্ধনে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছেন এটা কখনো নীরবে কখনো সরবে। ইসরাইলকে পশ্চিমাদের সাহায্য সামরিক, আর্থিক এবং নৈতিক সর্বক্ষেত্রে বিস্তৃত। তাদের এ সমর্থন ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যার মত ঘৃণ্য কাজে বেপরোয়া করে তুলেছে।

এ সমস্ত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ফিলিস্তিনীদের পক্ষে দক্ষিন আফ্রিকার অভিযোগ দায়ের। এরও আগে রোহিঙ্গাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেছিল। এ দুটি বিষয় আমাকে বিচলিত এবং বেদনার্ত করে। এর কারণ যখনই ভাবি গাজায় যখন নির্বিচার গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চলছে পুরা আরব দুনিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে কি একটি দেশও ছিল না ফিলিস্তিনীদের পক্ষ হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার। রোহিঙ্গাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার জন্য এশিয়াতেও কি একটি দেশও ছিল না। হয়ত নাই অথবা থেকেও ছিল না। কারণ দুটি ঘটনাতেই ভূরাজনীতি এবং ভূঅর্থনীতি জড়িত। এই দুই ভূ’এর যাতাকলে পৃথিবীর দেশে দেশে অঞ্চলে অঞ্চলে এখন মানুষের যত দুর্গতি। এই দুর্গতির শিকার ফিলিস্তিনের বিশেষ করে গাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ। মানুষের এ অপমান মানুষের এই অশেষ দুঃখ দুর্গতি কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তারা এ অন্যায় এ প্রতিবাদহীনতার বিরুদ্ধে নিজেরা আত্মাহুতি দানের মাধ্যমে মানুষের চেতনাবোধকে জাগ্রত করার অবলম্বন খুঁজে বের করেন।

এরন বুশনেল এমনই একজন। বুশনেল ২৫ বছরের যুবক। যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্সের সার্ভিসম্যান বুশনেল ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ দৃঢ় পায়ে ওয়াশিংটনস্থ ইসরাইলী দূতাবাসের দিকে অগ্রসর হন। তার হাতে ফ্ল্যাক্স। পথচারীদের ধারণা ছিল বুশনেলের হাতের ফ্ল্যাক্সে হয়ত চা বা কফি জাতীয় কোন কিছু রয়েছে। ইসরাইলী দূতাবাসের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে বুশনেল তার হাতের ফ্ল্যাক্স থেকে দাহ্য পদার্থ ঢেলে দেন সারা শরীরে। শরীরকে একটু সামনের দিকে বাঁকা করে হাঁটুর নীচে জ্বেলে দেন প্রতিবাদেও আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেন বুশনেল। জ্বলন্ত আগুন বুকে নিয়ে বুশনেল দশদিগন্ত কাঁপিয়ে শ্লোগান দেন : “ফ্রি প্যালেস্টাইন” ফ্রি প্যালেস্টাইন”।

বেশ কয়েকবার শ্লোগানে শ্লোগানে, আগুনের জ্বলন্ত শিখার মাঝে লুঠিয়ে পড়েন বুশনেল। এর আট ঘন্টা পর বুশনেল বিদায় নেন এই নশ্বর পৃথিবী থেকে। আত্তাাহুতি পুর্ব উইলে বুশনেল তার সম্পদের উত্তরাধিকারী করে গেছেন ফিলিস্তিনের অসহায় শিশুদের। তার প্রিয় বিড়ালটি দিয়ে গেছেন তার প্রতিবেশীকে।

বুশনেলের এই আত্মদান ফিলিস্তিনি নিরপরাধ শিশুদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে।

বুশনেলের এই আত্মদান ফিলিস্তিনি অসহায় নারীদের বোবাকান্না আর হত্যার শিকার হওয়ার প্রতিবাদে।

বুশনেলের এই আত্মদান ৩০(ত্রিশ) হাজারের ও বেশী ফিলিস্তিনিকে নির্বিকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে।

বুশনেলের এই আত্মদান গাজার ৫০% ঘরবাড়ী ক্রমাগত বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস স্ত্তুপে পরিণত করার প্রতিবাদে।

বুশনেলের এই আত্মদান গাজায় গণহত্যায় জড়িত ইসরাইলীদের যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ইন্ধন দানের প্রতিবাদে।

বুশনেলের এই আত্মদান গাজায় গণহত্যায় নীরব দর্শক বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা। বুশনেলের এ প্রচেষ্ঠায় মানুষের বিবেককে কিছুটা হলেও জাগ্রত করেছে। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ গণহত্যার এ অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে আজ বুশনেলের পোস্টার হাতে গাজা থেকে ইয়েমেন, কুয়ালালামপুর থেকে লন্ডন, প্যারিস থেকে নিউইয়র্ক সিটি সবখানে প্রতিবাদ বিক্ষোভে মানুষ ফুঁসে উঠেছে।

বুশনেলের আত্মাহুতিপূর্ব বক্তব্য পৃথিবীর মূল সংবাদ মাধ্যমগুলি তেমন প্রচার করেনি, সি এন এন এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে তা প্রচার করেছে। বুশনেল তার বক্তব্যে বলেছিলেন “আই এম এন এ্যাক্টিভ মেম্বার অব দি ইউ এস এয়ার ফোর্স, এ্যান্ড আই উইল নো লংগার বি কমপ্লিসিট ইন জেনোসাইড” যা বাংলা করলে দাঁড়ায় “আমি যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্সের একজন সক্রিয় সদস্য, আমি নিজেকে আর গণহত্যায় জড়াতে চাই না”।

তার আত্মাহুতির ঠিক পূর্ব মুহূর্ত আগে বুশনেল তার ফোনে রেকর্ড করেন “আই এম এ্যাবাউট টু এনগেইজ ইন এন এক্‌্রট্রিম এ্যাক্ট অব প্রটেস্ট, বাট কমপেয়ার টু হোয়াট পিপল হ্যাভবিন এক্সপিরিয়েন্সিং ইন প্যালেস্টাইন এ্যাট দি হ্যান্ডস অব দেয়ার কলোনাইজার, ইট ইজ নট এক্সট্রিম এ্যাট অল। দিস ইজ হোয়াট আওয়ার রুলিং ক্লাশ হ্যাজ ডিসাইডেট উইল বি নরমাল”। বুশনেলের এ বক্তব্য বাংলা করলে দাঁড়ায় “আমি চরম এক প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছি, আমার এই প্রতিবাদকে ফিলিস্তিনি জনগণের তাদের দখলদারদের হাতে প্রতিদিনের যে সহিংসতার অভিজ্ঞতা তার সাথে তুলনা করলে কিছুই না। আমাদের শাসকরা মানুষের এই চরম পরিণতিকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছেন”।

জো বাইডেনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন রাষ্ট্রপতি যথাক্রমে বিল ক্লিনটন, জর্জ ডাব্লিউ বুশ এবং বারাক ওবামা’ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বাদ দিয়েও নয়টি মুসলিম দেশ আক্রমণ করে প্রায় ১১ (এগার) মিলিয়ন নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে হত্যা করে। ডোনাল্ট ট্রাম বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের এ হত্যাযজ্ঞের রশি কিছুটা টেনে ধরলেও বৃদ্ধ বয়সে জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ হত্যার ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছেন। এটি ভাবলে অবাক লাগে, যে যুক্তরাষ্ট্র আবিস্কারেঅভিযাত্রায়, জ্ঞানে বিজ্ঞানে পৃথিবীতে সবচেয়ে অগ্রগামী সে যুক্তরাষ্ট্র মানুষের ইতিহাসে পৃথিবীতে প্রথম পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে। হিরোসীমানাগাসাকির কলংক তিলক যুক্তরাষ্ট্রের কপাল থেকে কখনো মুছে যাবার নয়। ভিয়েৎনাম, কাম্বোডিয়া, ইরান, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সোমালিয়া তথা আফ্রিকার দেশে মানুষ হত্যায়, মানুষের অপমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিতান্তই কলংকজনক একই সাথে পশ্চিমা বিশ্বেরও। সর্বশেষ ইউক্রেন ফিলিস্তিন।

এই যুক্তরাষ্ট্রে একদিন বর্ণবাদের শিকার হয়ে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী তার অলিম্পিক স্বর্ণপদক নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। এই যুক্তরাষ্ট্রই দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেছিল। এই যুক্তরাষ্ট্র থেকেই একদিন মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং তার ফ্রিডম স্পীচ এর মাধ্যমে সারা বিশ্বে মানুষে মানুষে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন। তার সে অকুন্ঠ ডাকের মর্মবাণী ছিল– “যখন আমরা মুক্তির আনন্দে উদ্ভাসিত হব, যখন স্বাধীনতার ধ্বনি বেজে উঠবে প্রতিটি শহর, বন্দর, জনপদে তখন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে স্রষ্টার সব সৃষ্ট মানুষ উচ্ছ্বসিত উদ্ভেলিত কন্ঠে গেয়ে উঠবে, অবশেষে আমরা মুক্ত স্বাধীন। স্রষ্টা তোমার কাছে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা, আমরা অবশেষে স্বাধীন হলাম বলে”। “ফ্রি প্যালেস্টাইন” ফ্রি প্যালেস্টাইন” এ শ্লোগানের মাধ্যমে এরন বুশনেল যেন মার্টিন লুথার’এর ফ্রিডম স্পীচ এর সেই প্রতিধ্বনি করে গেলেন এই এত বছর পর। ফিলিস্তিন দখলদার মুক্ত হোক। বুশনেল অমর হোক।

লেখক : কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপেক্ষার মহামারী ও বারুদের স্তূপের ওপরে জীবন উদযাপন
পরবর্তী নিবন্ধনারীদের এগিয়ে না নিলে সমাজ এগিয়ে যাবে না