২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ। তেল আবিবের উত্তরের শহর হারজেলিয়া – এর নামকরণ করা হয়েছে ইহুদিবাদের জনক থিউডর হারজেলের নামানুসারে। এই শহরে ইসরাইলস্থ বিভিন্ন দূতাবাস সমূহেরও অবস্থান। হারজেলিয়ায় ২০০০ সাল অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তেফাদা’র (ইন্তেফাদা– অবিচার, অন্যায়, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম) পর থেকে প্রতিবছর ইহুদি গবেষক, কৌশল প্রণেতা, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, ইহুদি ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ, বিশেষজ্ঞ স্তরের লোকজনদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর সম্মেলনের বিষয় পূর্ব নির্ধারিত এবং খুবই আগ্রহ উদ্দীপক ‘দি ব্যালেন্স অব ইসরাইল ন্যাশনাল সিকিউরিটি’ অর্থাৎ বাংলা করলে দাঁড়ায় ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা।
২০০৭ সালের হারজেলিয়ার এই সম্মেলনে প্রথমবারের মত ৪২ জন আমেরিকান কৌশল প্রণেতা যোগদান করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপ–প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গর্ডন ইংল্যান্ড, উপ–পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিকোলাস বার্নস, প্রিন্সটন ইউনির্ভাসিটির অধ্যাপক বার্নাড লেউইস। ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এহুদ এলর্মাটসহ মন্ত্রী সভার প্রায় অর্ধেক মন্ত্রী এই সম্মেলনে উপস্থিত হন। সম্মেলনে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই আলোচনা মধ্যপ্রাচ্য তথা পৃথিবীর ভূ–রাজনীতির ইতিহাসে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনার মাইল ফলক হয়ে থাকবে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান। কারণ এ যাবতকাল ইসরাইল তথা ইহুদিবাদের প্রথম এবং একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ছিল ফিলিস্তিনীদের সাথে ইসরাইলীদের বিবাদ–বিরোধ। ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীরা ক্রমাগত ফিলিস্তিনীদের তাদের বাস্ত্তুভিটা থেকে উৎখাত করেও একটি বিষয়ে সমস্যার কূলকিনারা পাচ্ছিল না। এ সমস্যা হল ইসরাইলীদের তুলনায় ফিলিস্তিনীদের অনেক বেশি জন্মহার এবং এই প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনীদের ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এটি বিবেচনায় নিয়ে ২০০৫ সালে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী এ্যারিয়েল শ্যারন গাজা উপত্যকা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এতে ইসরাইলীদের মনোভাব ছিল যাক অন্তত গাজার ১.৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার ভার ইসরাইলকে বহন করতে হবে না। কিন্ত্তু ২০০৭ হারজেলিয়া সম্মেলন এ হিসাব নিকাশ উল্টে দিয়ে সামনে নিয়ে আসে ইরানকে। সম্মেলনের স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনী বা আরব নয় ইরানই হবে ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ইসরাইলের জন্য প্রধানতম হুমকি এবং বিনাশকারী শক্র। তারা আরও সিদ্ধান্তে আসেন ইসরাইলের প্রতি ইরানের পক্ষে এ হুমকি তখনই বাস্তবতা লাভ করবে যখন ইরান পারমানবিক শক্তিধর হবে। সুতরাং ইরানকে কোন অবস্থাতেই পারমানবিক শক্তির অধিকারী হতে দেওয়া যাবে না।
আমেরিকা এবং ইসরাইল দুটি দেশই একই যুক্তিতে উপনীত হয়–ইরান পারমানবিক শক্তিধর হলে মধ্যেপ্রাচ্যে ইসরাইলের নিরাপত্তা চরম হুমকিতে পড়বে আর আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া কৌশল আর ধোপে টিকবে না। এখানে আমেরিকার নীতি নির্ধারক এবং কৌশল প্রণেতাদের সামনে আরো একটি বিষয় উঠে আসে তা হল ইরান পারমানবিক শক্তি সামর্থ্যের অধিকারী হলে মধ্যেপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও ভারসাম্যের কথা বলে পারমানবিক শক্তি অর্জনের পথে পা বাড়াবে। এ অবস্থায় মধ্যেপ্রাচ্য জুড়ে আমেরিকার বিদ্যমান প্রভাব প্রবলভাবে বির্পযস্ত হবে। এর বাইরেও ইরান পারমানবিক শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হলে মধ্যে প্রাচ্যে আমেরিকার তাবেদার সরকারগুলি অস্তিতিশীলতার মুখে পড়বে যা নিশ্চিতভাবে আমেরিকার স্বার্থের প্রতিকূলে যাবে। এসব ভাবনা থেকে পাশ্চাত্য এবং ইসরাইলের কোনো কোনো কৌশল প্রণেতা ইরান পারমানবিক শক্তি অর্জনের আগেই তার পারমানবিক স্থাপনা সমূহ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যুক্তি তুলে ধরেন। এক্ষেত্রে তারা ১৯৮১ সালে ইরাকের ওশিরাখ পারমানবিক স্থাপনা ধ্বংসের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। ইরান আক্রমণের অজুহাত সৃষ্টির জন্য কোনো কোনো সমর কুশলী সাদ্দামকে দিয়ে কুয়েত দখল করানো তারপর ইরাক আক্রমণ করে ধ্বংস করার মত ফাঁদ পাতার সুপারিশও করেন, এদের মাঝে তৎকালীন ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল ইউরি সাগুই ছিলেন অন্যতম। আবার কেউ কেউ ইরানের উপর ইরাকের মত কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ এবং নো ফ্লাই জোন আরোপ করার জোর সুপারিশও করেন, এদের মাঝে একসময়ের ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডানিয়েল লেশাম অন্যতম। ওয়াশিংটনের ইসরাইলী কট্টর সমর্থকরা নিশ্চিত ছিলেন ইরাক দখলের পরপরই আমেরিকানরা ইরানের উপর হামলে পড়বে। কিন্ত্তু এটি ঘটার আগেই আমেরিকা ইরাকে এক অঘোষিত গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বুশ প্রশাসন ঘোষিত ‘এক্সিস অব এবিল’ এর প্রথম এবিল ইরাকেই আমেরিকা লেজেগোবরে অবস্থায় পড়ে য়ায়। ইরান–উত্তর কোরিয়া এই দুই ‘এবিল’ তখনকার মত আমেরিকান আক্রমণের হাত থেকে নিরাপদ থাকে। আমেরিকার যুদ্ধবাজ নেতাদের সে সময় আরো একটি বিষয় এবং দুজন ব্যক্তির ভূমিকা ইরান আক্রমণে অনেকটা নিরাসক্ত করে। বিষয়টি হল ইরাকের কাছে গণ বিধ্বংসী অস্ত্রের মওজুদ আছে বলে ইরাক আক্রমণ এবং পরে ইরাক দখলের পর তা ভূয়া প্রমাণিত হওয়া। যে দু ব্যক্তির ভূমিকার কথা উল্লেখযোগ্য তার মধ্যে পৃথিবীর সভ্যতাকামী মানুষেরা যার কথা সব সময় মনে রাখবে তিনি স্কট রিটার। স্কট রিটার সে সময় জাতিসংঘ নিয়োজিত ইরাকে প্রধান অস্ত্র পরির্দশক ছিলেন। আমেরিকার ইরাক আক্রমণের পূর্বে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইরাকের কাছে কোনো গণ–বিধ্বংসী অস্ত্র মওজুদ নেই। এটা করে স্কট রিটার ওয়াশিংটনের ইসরাইলী লবির প্রচণ্ড বিরাগবাজন হয়েছিলেন। এর পরও আমেরিকার ইরাক আক্রমণ থেমে থাকেনি। লক্ষ ইরাকী হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর বিশ্ব সত্য জানল, স্কট রিটার সত্য পুরা পাশ্চাত্য মিথ্যা। এর পরও ইরান আক্রমণের অজুহাত দাঁড় করানোর জন্য আমেরিকান এন্টারপ্রাজের মাইকেল লেডেন নামক বিখ্যাত এক বুদ্ধিজীবী প্রচার করা শুরু করেন আমেরিকার ইরাক আক্রমণের আগে আগে ইরানী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বোমা তৈরীর সমৃদ্ধ পারমানবিক জ্বালানী ইরানে পার করে নিয়ে গেছেন। তৎকালীন জাতিসংঘ পারমানবিক পর্যবেক্ষক দলের প্রধান আল বারাদি সাফ সাফ জানিয়ে দেন ইরানের কাছে তাদের ‘নাথানজ’ পারমানবিক স্থাপনায় মাত্র কয়েক শ সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে যা বেসমারিক জ্বালানী উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরান রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত ‘বুশের’ পারমানবিক স্থাপনা পরিদর্শনে জাতিসংঘ পরিদর্শক দলের যে কোন সর্ত মানতেও রাজি বলে জানিয়ে দেয়।
এ পরিস্থিতিতে ইরান আক্রমণের জন্য ইসরাইল আর তার মিত্ররা ভিন্ন পথ খুঁজতে থাকে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য ইরানী পারমানবিক স্থাপনায় ‘সাইবার এ্যাটাক’, ইরানী আনবিক স্থাপনায় কাজ করে এমন উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীদের হত্যা বিশেষ করে পারমানবিক অস্ত্র উৎপাদন কর্মসূচীর প্রধান মোহসিন ফখরজাদের হত্যাকাণ্ড, বাগদাদ এয়ার পোর্টে ইরানী জেনারেল কাসেম সোলেমানীর হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি। এসবের উদ্দেশ্য ছিল ইরানী প্রতিক্রিয়ার জবাবে ইরান আক্রমণের অজুহাত খুঁজে নেওয়া। ইরান অত্যন্ত সর্তকতা এবং হিসাব কষে পা ফেলেছে। ইরান যা করার তা তার তিন ‘এইচ’ মাধ্যমে করেছে। এই তিন এইচ হল লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়ামেনের হাউতি আর গাজার হামাস।
১ এপ্রিল ২০২৪ ইসরাইল দামেস্কস্থ ইরানের কনস্যুলেট আক্রমণ করে বসে। সেই আক্রমণে ইরানের ইসলামী রেভ্যুলুশনারী গার্ডের কুদস ব্রিগেডের দুজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার ডেপুটি জেনারেল মোহাম্মদ হাদি সহ সাতজন সেনা সদস্য নিহত হন। আমেরিকা এবং ইসরাইল বরাবরের মত হয়ত ধরে নিয়েছিল ইরান তার প্রক্সির মাধ্যমে কিছু মিসাইল ছুড়বে নয়ত কোথাও ইসরাইলী কোনো দূতাবাস আক্রমণ করবে। এবার সে রকম কিছু হয়নি। ইরান তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে দীর্ঘ তের দিন সময় নিয়েছে। এই তের দিন ইরান বিশ্বের যাবতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটায়।
ঘটনা শুরুর ৭২ ঘণ্টা আগে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহকে ইসরাইল আক্রমণের বিষয়টি অবহিত করে যেন তাদের আকাশ পথ তারা নিরাপদ রাখতে পারে। ইতিমধ্যে আমেরিকা ইসরাইলও তা জেনে যায়। মেডিটেরিয়ানে অবস্থিত আমেরিকা তার দুটি ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপকে সতর্ক অবস্থায় রাখে। একই সাথে বৃটেন এবং ফ্রান্সকেও আমেরিকা এতে যুক্ত করে। ১৩ এপ্রিল মধ্য রাতে ইরান হামলার প্রথম ধাপে ১৭০ টি ড্রোন উৎক্ষেপণ করে। ইরান এবং অন্যান্য উৎক্ষেপণ স্থল থেকে এসব ড্রোনের ইসরাইলে আঘাত করতে ৫ ঘণ্টার মত সময় নেওয়ার কথা। প্রথম ধাপের এই ড্রোন ইরান আমেরিকা তথা পাশ্চত্যের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ব্যস্ত করার ইরানী একটি কৌশল বলে প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ইরান ক্রুজ মিসাইল উৎক্ষেপণ করে যা ইসরাইলে আঘাত করতে মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় নেয়। এসব ড্রোন, ক্রুজ মিসাইলকে ধ্বংস করতে আমেরিকা, বৃটেন এবং ফ্রান্স তাদের ২০০ এর ও বেশি ফাইটার এয়ার ক্রাফট আকাশে ওড়ায়। ইতিমধ্যে বিস্ময়করভাবে ইরান তৃতীয় ধাপে তাদের ব্যালেস্টিক মিসাইল সাহাব ছোড়ে। এই ব্যালেস্টিক মিসাইলের লক্ষ্য বস্ত্তু ছিল মূলত তিনটি ‘নাভাথিম’ এয়ার বেইস, বামউত এয়ার বেইস এবং গোলান হাইটে অবস্থিত ০০১ ইসরাইলী এবং আমেরিকান যৌথ গোয়েন্দা দপ্তর।
এখানে উল্লেখ্য পৃথিবীর সবচেয়ে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছায়াতলে ইসরাইলীরা। এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমেরিকার কলারাডো থেকে নিয়ন্ত্রিত। এর মাঝে আরো রয়েছে ইসরাইলী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এ্যারো ২ এ্যারো ৩, আমেরিকান প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ডেভিট স্লিং নামক আকাশ প্রতিরক্ষা সর্ব্বোপরি নিশ্চিদ্র ‘আয়রন ডোম’।
সব প্রতিরক্ষা নিশ্চিদ্রতাকে তছনছ করে ইরানের ছোড়া ৭ টি ব্যলেস্টিক মিসাইলের ৫ টি তার লক্ষ্যবস্ত্তু নাভাথিম এয়াফিল্ডে আঘাত হানে। ইরান তার মূল ক্ষেপণাস্ত্র ‘ফাতেহ’ এখনও ব্যবহার করেনি। এখন ইরানকে নিয়ে পাশ্চাত্যের মাথায় হাত কারণ ইতিমধ্যে রাশিয়া এবং চীনের সাথেও ইরান বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।