সভ্যতায় ফ্যাশন

| সোমবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৭:২৬ পূর্বাহ্ণ

.ওবায়দুল করিম

আজ থেকে এক বছর আগে, চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি এর যাত্রা শুরু হয়। কিছুদিন আগে বছর অতিক্রমের আনন্দঘন দিবস উদযাপিত হয়েছে। পুরো ইউনিভার্সিটির নামের দুটো শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরবার চেষ্টা করবো।

বলা হয়, ‘Man is inherently fashioned animal’, বা মানুষ জন্মগত ভাবে ফ্যাশন প্রিয় মানুষ। প্রাণী জগতে কোনও প্রাণীই ফ্যাশনে আকৃষ্ট নয়, একমাত্র মানুষ ছাড়া। মানুষ যখন খাদ্য সংগ্রহ করতো, প্রকৃতির কাছে ছিলো অসহায়, তখনও সে ফ্যাশন প্রিয় ছিলো। গাছের ছালবাকল দিয়ে বানানো পোশাকের রকমফের তাই প্রমাণ করে। এখনও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের সৌন্দর্য চর্চায় গ্রীবাকে লম্বা করা, চুলের বিশেষ বিনুনি, বাঁশের অলঙ্কারের ব্যবহার ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহকে নির্দেশ করে। ফ্যাশন মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি হলেও, সমাজ সৃষ্টি ও মানুষ অর্থনৈতিক প্রাণী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পরে, ফ্যাশন আর মানুষের inherent বা inborn আচরণের অংশ নয়, বরং পুরোটাই বলতে গেলে সামাজিক হয়ে উঠেছে। ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, মানুষের জীবনের চলনবলনের জগত বা Lifestyle যা ফ্যাশন থেকে উৎসারিত তাই বদলে দিয়েছে। এছাড়া শ্রেণি ও স্তরে বিভক্ত সমাজের মানুষের রুচিভেদ ভিন্ন মাত্রায় গড়ে উঠেছে। আর সামাজিক ব্যবস্থাও ফ্যাশন ও পোশাকপরিচ্ছদকে এক ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করে। দাস ব্যবস্থায় গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় দাস মালিক ও অভিজাতদের পোশাক ও পরিচ্ছদ ও দাস ও সাধারণ মানুষের একই রকম ছিলো না। সামন্ত ব্যবস্থায় রাজন্যবর্গের পোশাক ও ফ্যাশন আধুনিক শিল্প সমাজে বদলে গেছে। এ থেকে এই ধারণা করা যায়, সমাজ ব্যবস্থা বদলালে, ফ্যাশন ও জনগণের Lifestyle ও বদলে যায়। আবার সমাজ বদলে যাওয়ার শর্ত হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিবর্তন। প্রযুক্তি না বদলালে সমাজ কখনোই বদলাতো না।

এবার আসা যাক, প্রযুক্তির ধারণায়। বিজ্ঞান প্রকৃতিকে জানে ও প্রকৃতিকে বদলানোর উপায় বাতলায়। ‘বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান নয়’, মানুষের জীবনকে সহজ ও আরামপ্রদ করবার জন্য বিজ্ঞান। বিজ্ঞান দিয়ে প্রকৃতি বদলায় না, দরকার প্রযুক্তির। বিজ্ঞানের তত্ত্ব প্রয়োগের জন্য প্রযুক্তির প্রয়োজন। কীভাবে গরমে, কোন গৃহ পরিবেশকে শীতল করতে হয় তা বিজ্ঞান জানায়, কিন্তু শীতল করতে হলে Air Conditioner নামের ডিভাইস বা প্রযুক্তির দরকার। এজন্যই বলি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে চলে। প্রযুক্তিও কিন্তু বিজ্ঞানেরই আবিষ্কার। মোদ্দা কথায় বলা যায়, কোনও প্রযুক্তি ছাড়া বা ডিভাইসের ব্যবহার ছাড়া আমাদের সমাজ, অর্থনীতি যা আমাদের লাইফস্টাইলকে নির্দেশ করে তা অচল।

আপনি চুল আঁচড়াবেন, অবশ্যই দরকার চিরুনি বা ঐ সদৃশ কোনও অবজেক্ট। আর তাইতো প্রযুক্তি। গলায় নেকলেস বা কোন অলংকার পড়বেন, অবশ্যই তা বানাতে প্রযুক্তি লাগবে।

আমরা এক সময়ে খাদ্য সংগ্রহের অর্থনীতিতে ছিলাম। কিন্তু আগুনের আবিষ্কার ও তার ব্যবহার করতে পারায়, আমরা খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হলাম। কারণ আগুনের ব্যবহার জানি বলেই লোহাকে পুড়িয়ে লাঙ্গল বানাতে পারলাম। ফলে আমরা সভ্য হলাম। আমরা তৈরি করলাম পরিবার, সংঘ, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান আর এগুলোকে সচল রাখতে হলে, মানুষের নৈকট্য ও সংহতি দরকার, আর একারণে এলো, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আইনকানুন ইত্যাদি। আমরা যখন নিজেদের সভ্য বলি, উল্লিখিত বিষয়াবলীর অস্তিত্বমান না হলে নিজেদের সভ্য বলে দাবী করতে পারতাম না। এগুলোও পোশাক। বস্ত্র পরিধান করি, আর আইনকানুন মেনে সভ্য দাবী করি। আমাদের সমাজের পরতে পরতে এখন আমরা আইনকানুন, মূল্যবোধ বা বিশ্বাসের পোশাক পরে আছি। এজন্য এখন অনেকেই আজকের সমাজকে পোশাকি সমাজ বা কসমেটিক সোসাইটি (Cosmetic Society) বলে উল্লেখ করে থাকেন। এ কথাতো জানি ব্যক্তি জীবনে আমরা সাংঘাতিকভাবে পোশাক তাড়িত। আগেই বলেছি, আমাদের বিশ্বাস ফ্যাশন নির্ধারণ করে থাকে।

সমাজ বদলাচ্ছে, হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজ। ফলে প্রান্তস্থ দেশের মানুষের রুচি, পোশাকপরিচ্ছদ, Attire, ফ্যাশনেও পরিবর্তন হচ্ছে। চীনের এক সমাজবিজ্ঞানী Concept of Beauty নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বর্ণনা করলেন যে, গ্লোবালাইজেশনের আগে, প্রান্তস্থ দেশগুলোতে মহিলারা তাঁদের দেশ উপযোগী ধারণায় মহিলারা রূপচর্চা করতেন। যেমন আফ্রিকার মহিলারা কোঁকড়ানো চুল, মোটা ঠোঁট পছন্দ করতেন। গ্লোবালাইজেশন স্থানীয় রূপচর্চা আর লাইফস্টাইলকে শেষ করে দিয়েছে এখন আফ্রিকান মহিলারা ইউরোপের সাদা চামড়াধারীদের মতো, চিকন ঠোঁট, চুলের স্ট্রেটকাট পছন্দ করে। আমাদের দেশেই প্রসাধন হিসেবে ‘আলতা’ এর ব্যবহার আমরা ভুলেই গেছি। এই পরিবর্তন বিশ্বের সমাজ তথা প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।

মানুষের ফ্যাশনের জন্য উপকরণ দরকার। যেমন পাউডার, লিপস্টিক বা পোশাকের ক্ষেত্রে কাপড় ও তার হরেক রকমের ভ্যারিয়েন্ট। এগুলো প্রাচীনকালে ছিলো না, ফলে ফ্যাশন ছিলো সীমিত আকারে। এখন প্রযুক্তির রয়েছে বাহারী রূপ ফলে ফ্যাশনও হয়েছে বহু মাত্রার বাহারী।

পণ্য উৎপাদনের সমাজে ফ্যাশনের সামগ্রীও পণ্য, কারণ এর ব্যবহার ও বিনিময় মূল্য দুইই আছে। পোশাক ও পণ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা নির্ভর করে প্রচলিত ফ্যাশন ও উৎপাদিত পণ্যের মানের উপর। বাংলদেশ উন্নয়নের অভিযাত্রায় আছে। এই সামর্থ অর্জনে রেমিট্যান্স ও RMG (Readymade Garments)বা তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান মূলত প্রধান। RMG, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই সম্ভাবনাই, বাংলদেশে ভৌত উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে । মনে রাখা দরকার, মানুষের লাইফস্টাইল বা ফ্যাশন প্রযুক্তি নির্ভর। প্রযুক্তির পরিবর্তন মানুষের জীবনাচারের ও ফ্যাশনের পরিবর্তনের নিয়ামক।

আজকাল লাইফস্টাইল ইন্ডাস্ট্রি ও লাইফস্টাইল কালচার বলে কথা প্রচলিত হচ্ছে। পণ্যের যত উৎপাদন, সবই মূলত মানুষের লাইফস্টাইলের সাথে জড়িত। সে হোক জুতা, পরিধেয় বস্ত্র, আসবাবপত্র, গাড়ি , কিংবা বাড়ি এমনকি খাবারদাবারও। আর সব উৎপাদনের ফ্যাশন এখন উন্নয়নের সাথে জড়িত। বাড়ির ডিজাইন, বাড়ির ফ্যাশনকেই বোঝায়। আর আগেই বলেছি ফ্যাশন মূলত প্রযুক্তি নির্ভর। ফ্যাশন এখন একটি শিল্প মাধ্যম। এবং ফ্যাশন বাণিজ্যিক পণ্যও বটে ।

তো বাংলাদেশের মানুষের লাইফস্টাইল পরিবর্তনে এ খাত এক প্রধান ভূমিকা রাখছে। তবে এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারা বোঝা, আমাদের পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের ধারণায় থাকতে হবে। পণ্য উৎপাদনের প্রযুক্তি হামেশাই পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন মানুষের পোশাক নির্ভর রুচির জগতেও পরিবর্তন আনছে। ফলে পোশাক ও লাইফস্টাইল নির্ভর পণ্য উৎপাদনে এর নান্দনিক ও গুণগত মান বজায় রাখার বিষয়টা প্রধান। আর এখানেই নির্ভরতার যায়গা হচ্ছে, প্রযুক্তি। আজকের সভ্যতায় শুধু হিউম্যান লেবার বা মানুষের শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন হয় না। দরকার সঞ্চিত শ্রম বা পুঁজির বা সহজ ও মোদ্দা কথায় প্রযুক্তি। যতো নান্দনিকতা আমরা দেখি, প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া তার কোনোটাই নির্মিত হয়নি। উৎপাদনের যত উপকরণ আছে, তার ভেতর প্রযুক্তিই প্রধান।

লেসলি হোয়াইট নামের এক নৃবিজ্ঞানী আছেন, তাঁর বর্ণনায়, শক্তির উৎসের সন্ধান ও তার ক্রমাগত যোগ মূলত সমাজ ও অর্থনীতিকে বদলায়। এই যেমন আগুনের আবিষ্কার শক্তির অন্যতম উপায় আর এর ব্যবহার না জানলে, হত না লাঙ্গলের আবিষ্কার, হত না কৃষি সভ্যতার পত্তন। আবার কয়লা, গ্যাস, তেল ইত্যাদির আবিষ্কার না হলে, গাড়ি, লোকোমোটিভ চলতো না। প্রযুক্তির প্রয়োগের জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। বাহুর শক্তি অথবা প্রকৃতি থেকে আহরিত শক্তি ব্যবহার করে প্রযুক্তির প্রয়োগে আমাদের সমাজ আর অর্থনীতির পরিবর্তন হয়। আর লাইফস্টাইল বা ফ্যাশনের জগতও শক্তি আর প্রযুক্তি পরিবর্তনের সহগামী। মানুষের বাহুর শক্তির সাথে ক্রমান্বয়ে কয়লা, তেল, গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পারমাণবিক, সোলার ইত্যাদি শক্তির যোগ না হলে আজকের ফ্যাশনের জগত অতিমাত্রায় সাধারণ হতো। কারণ, বস্ত্র ও অন্যান্য পরিধেয় দ্রব্যসামগ্রী তৈরির উপকরণ শুধুমাত্র হার্ব বা গাছপালা সংগ্রহ করা হয় তা নয় বরং এখন খনি থেকে আহরিত হয় বেশি। এবং সেই কাঁচামালের প্রসেসিংয়ে শক্তি ও প্রযুক্তির দরকার হয়। আর এই প্রসেসিংয়ের জ্ঞান খুব জরুরি।

প্রযুক্তির দুটো দিক। প্রথম হলো, এর বস্তুগত দিক বা অবজেক্ট। যা ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। প্রযুক্তি অতি অবশ্যই সংস্কৃতিও বটে। ফলে প্রযুক্তির বস্তুগত দিক হচ্ছে যেমন, কারখানার মেশিন। আবার মেশিন চালানোর যে জ্ঞান, যা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তা হলো অবস্তুগত সংস্কৃতি। প্রযুক্তির এই দিক অর্থাৎ মেশিনপত্র চালানোর এই জ্ঞান শিখে নিতে হয়। সমাজের আইনকানুন, রীতিনীতির সাথে যেমন জন্মের পর থেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয় যা সামাজিকীকরণ বলে আমরা জানি তা শিক্ষণও বটে ঠিক তেমনি সমাজে প্রযুক্তি চালানোর জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া শিক্ষণ এবং একই সাথে সামাজিকীকরণও বটে ও শিশুর সামাজিকীকরণের জন্য আছে পরিবার, স্কুল, কলেজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঠিক তেমনি কর্মের পরিবেশের সামাজিকীকরণ বা শিক্ষণের জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তার প্রধান হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কর্মে স্পেশালাইজড্‌ করবার জন্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। আর বিষয়টিকে অনুধাবন করেই চট্টগ্রামের পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পপতিরা সাবেক বিজিএমইএ’র প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করেন।

লেখক : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও নতুন শিক্ষাক্রম
পরবর্তী নিবন্ধসামর্থ্যবানরা এগিয়ে আসলে শীতার্তদের কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে