সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের একক অধিকারের স্বীকৃতি

| রবিবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সনদ পেতে ফরম পূরণের সময় অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতা আর থাকছে না। এখন থেকে কারও বাবা না থাকলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে বাবার পরিচয় ব্যবহার করতে না চাইলে মা কিংবা আইনগতভাবে অন্য কোনো অভিভাবকের নাম যুক্ত করতে পারবেন বলে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ২৪ জানুয়ারি বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। শিক্ষা সনদের জন্য ফরম পূরণের ক্ষেত্রে আগে শুধু ‘বাবার নাম’ ব্যবহার করা যেত। ঐতিহাসিক এই রায়ের ফলে এখন থেকে বাবার নামের পাশাপাশি আরও দুটি অপশন যুক্ত হলো। এতে করে কেউ চাইলে বাবার পরিচয় ব্যবহার না করেও শিক্ষা সনদ পেতে ফরমপূরণের সময় মা কিংবা আইনগতভাবে বৈধ অভিভাবকের নাম লিখতে পারবেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়,

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগে শিক্ষার্থী তথ্য ফরমে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাবার নাম পূরণ করতে না পারায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাজশাহী ঠাকুরগাঁও জেলার এক তরুণীকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তী সময় এ ঘটনার যথাযথ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ যৌথভাবে জনস্বার্থে রিট করে। সেই রিটের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহম্মেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। একপর্যায়ে রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২৪ জানুয়ারি রায় দিলেন দেশের উচ্চ আদালত।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এই রায়ের ফলে মায়ের অধিকারও আংশিক প্রতিষ্ঠিত হলো। আর মাতাপিতার পরিচয়হীন যেকোনো শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হলো। আমরা মনে করি, এটা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ১০০ ধাপের এক ধাপ। আমাদের আরও কাজ করতে হবে। স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে মায়েরা, বিশেষ করে একক মায়েরা নিজ পরিচয়ে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারবেন। ভুক্তভোগী মায়েদের জন্য এ রায় কতটা স্বস্তিদায়ক হলো, তা শুধু তারাই অনুভব করতে পারবেন। তাদের জন্য সামাজিক এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাটা খুব কষ্টকর ছিল। এই গ্লানি ও অসম্মানের মধ্যে দিয়ে যাঁদের যেতে হয়নি, তাঁরা বুঝতেই পারবেন না এই একটুখানি পাওয়া তাদের জন্য কতটা বেশি পাওয়া।’

নারী অধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা মনে করেন উচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত নারীর অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ, এখনও অনেকদূর যেতে হবে। এখনও অভিন্ন পারিবারিক আইন, সম্পত্তির অধিকারসহ অনেকগুলো পদক্ষেপ বাকি রয়েছে, যেগুলো আদায়ের জন্য এখনও আন্দোলন করে যাচ্ছেন নারী অধিকারকর্মীরা। তাঁরা বলেন, “লিঙ্গ বৈষম্যমূলক প্রথা দূরীকরণের ক্ষেত্রে এই রায়টি যুগান্তকারী। প্রত্যেক ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশের অধিকার এবং শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিতে এই রায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। লিঙ্গভিত্তিক সকল বৈষম্য দূরীকরণের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পূরণে এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন নিশ্চিতকরণে এই রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই আইন ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবায়নে গিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। অনলাইনে যতগুলো ফরম আছে, সেখানে সব জায়গায় বাবার নাম বাধ্যতামূলক করা আছে। অথচ অনেক জায়গাতেই আইনে এর প্রয়োজন নেই। এগুলো নিয়ে এখন কাজ করতে হবে।”

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে ফরম পূরণে পিতার নাম বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখের সুনির্দিষ্ট আইনগত কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও এতকাল ধরে পিতা মাতার পরিচয় বিহীন শিশুরা শিক্ষা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। এখন আমরা আশা করছি, এ যুগান্তকারী রায়ের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সকল শিশুর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন হবে। এখন আমাদের সামনের দিনে যে কাজটা করতে হবে সেটা অভিন্ন পারিবারিক আইন বাস্তবায়নের কাজ। ইতিমধ্যে আমরা আন্দোলনও করছি। সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রেও আইন সংশোধন করতে হবে। এগুলো নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি আইনী লড়াইয়েও আমরা যাব।’

আসলে সন্তানের ওপর মায়ের অভিভাবকত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এটা এক বিরাট অর্জন। এই অর্জনকে কার্যকরভাবে প্রয়োগের লক্ষ্যে আমাদের আরও তৎপর হতে হবে। যুগ যুগ ধরে সমাজে যে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য চলে আসছে, উচ্চ আদালতের এই রায়ের কারণে কিছুটা হলেও অবসান হলো। এর মাধ্যমে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে বাবার অনুপস্থিতিতে মায়ের একক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে