জানি গল্পই পড়ছি। তবু গল্পের কিছু কিছু বাক্য যখন চোখ ঝাপসা করে দেয়, পড়তে পড়তে যখন গলা ধরে আসে, যখন মনে হয় ঘটনা বুঝি চোখের সামনেই ঘটছে, তখনই মনে হয় লেখকের পরিশ্রমটুকু সার্থক। লেখাটুকু আর লেখকের নিজের থাকে না। লেখক দক্ষতার সাথে পাঠকের মনে একটা জায়গা করে নিতে সক্ষম হন।
বলছিলাম গল্পকার সাদিয়া সুলতানার কথা। তার গল্পগ্রন্থ “মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ” পড়ছিলাম আর গল্পকারের ভাবনার সাথে নিজের ভাবনার মেলবন্ধন খুঁজছিলাম।
সাদিয়া সুলতানার কয়েকটা গল্প পড়েছিলাম “গল্পপাঠ” এ। কিন্তু সাদিয়া সুলতানার ভক্ত হয়েছি তার “আহুতি” গল্প পড়ে। “মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ” বইয়ের দ্বিতীয় গল্প আহুতি।
“আমাদের ঘরে কখনো সকাল আসে না। এখানে সময় স্থির, স্তব্ধ। ভৌতিক আঁধারে দিনরাত্রির হিসাব ভুলে আমরা এই ঘরে নিশ্চল বসে থাকি।থেকে থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা, ব্যাঙের ডাক শুনতে পেয়ে অন্ধকারের ঘনত্ব, লোকালয়ের দূরত্ব মাপার চেষ্টা করি।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝিঁঝিঁ পোকার নিরবিচ্ছিন্ন শব্দ ভেদ করে জিপের চাকার ভয়ালো শব্দ জোরালো হতে থাকলে আমাদের বুকে তোলপাড় ভয় জাগে।” আহুতি গল্পের শুরুর কয়টা লাইন। যেগুলো বারবার পড়তে ভালো লাগছিল।
নীলিমা ইব্রাহীম এর “আমি বীরাঙ্গনা বলছি” আগেই পড়া ছিল বলেই হয়তো এই গল্পের চরিত্রগুলোকে খুব চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু গল্প লেখক চেনা মানুষগুলোকেই আরেকবার তুলে ধরেছেন তার কলমের অসাধারণ নৈপুণ্যে। এই গল্প পড়ে নিজেকে সংযত রাখা কঠিন।
এই আহুতি গল্পের আরো দুটি লাইন তুলে দিচ্ছি, যেগুলো মনে জায়গা করে নিয়েছে।
“এই ঘরে একটি মাত্র জানালা। দরজা দুটি। যেই দরজা দুটি দিয়ে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকা যায়। কিন্তু বের হওয়া যায় না”
“প্রোডাক্ট” গল্পটায় কণা নামের মেয়েটির “স্নেহ নীড়” এ ফিরে আসার বর্ণনাটুকু কী মায়াবী! শুধু মানুষের কাছ থেকে মায়া, দয়া, ভালোবাসা হারিয়ে যায় বলেই কণার কানের কাছে এসে নার্স বলতে বাধ্য হয়, “আমি ভাই ইনকমপ্লিট অ্যাবরশন করি না, এমনভাবে করছি যে ভেতরে কোনো প্রোডাক্টই নাই”।
আমার শরীরের তিলতিল করে বেড়ে ওঠা মানব শিশু যখন কারো অবহেলা আর অবজ্ঞায় হয়ে ওঠে “প্রোডাক্ট” নামের অস্তিত্ব, তখন নিজেরই কেমন অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে থাকা নারীর মনোজগতটা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন লেখক।
“মাটি” গল্পটা পড়তে গিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্য’র “সিঁড়ি” কবিতার কথা মনে পড়ছিল।”আমরা সিঁড়ি, তোমরা আমাদের মাড়িয়ে, প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও; তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে; তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক, পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।” এই কবিতা পড়ে যেমন থমকে যেতাম, আসলেই তো কখনো তো এভাবে ভাবিনি সিঁড়িরও তো কিছু বক্তব্য থাকতে পারে।
সাদিয়া সুলতানার ‘মাটি’ গল্পটা পড়েও একই অনুভূতি হয়েছে। গল্পে মায়ের জন্য ডাক্তার আনতে যাওয়া ভাই-বোনের কথোপকথনের অংশটুকু পড়তে গিয়ে দেখি সেই একই অনুভূতি জেগে উঠেছে মনে।
‘ও ভাইজান, মাটি কি কাঁদছে?’ হতবিহবল ভাইয়ের পরনের শার্ট ফুঁড়ে অন্ধ বাতাসের ঢেউ ওর অন্তরাত্মা ছুঁয়ে যায়। এক অজানা অনুভূতিতে কেঁপে উঠে ভাইটি প্রতিউত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ রে বোন, মাটি কাঁদছে।’
আমাদের সন্তানদের যে আমরা পড়ালেখা, জিপিএ, ক্যারিয়ার এসব নিয়ে কি পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণার ভেতর রাখি, বাচ্চাদের মনোজগতকে যে আমরা থোড়াই কেয়ার করে কেবল ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ করে চিৎকার চেঁচামেচি করে তাদের বর্তমানকেই ভয়ংকর অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেই তারই ভয়াবহ পরিনাম হচ্ছে “একটা বেমানান পাখি” গল্পটি। মিশু নামের চরিত্রটির মনোজগত খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন গল্পকার।
অন্যরকম গল্প “ডুবসাঁতার”। আমরা স্বীকার করি কিংবা না করি সম্পর্কের কিছু গোপন বৈশিষ্ট্য থেকেই যায়। সেরকমই এক সম্পর্কের গল্প ‘ডুবসাঁতার’।
দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েনে নাজনীন নামের মেয়েটি দেখানো সুখ সুখ জীবনের আড়ালে যে অন্তর্দাহে পুড়ে যায়, এত সুখের মাঝেও মনের অসুখের কথা সে টের পায়, নাজনীন নামের মেয়েটি এই সমাজের অনেক নাজনীনের প্রতিরূপ হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠে নিরীহ কীটপতঙ্গ, পাখি, প্রাণী। “অ-সুখের শব্দ” নামে এই গল্পটিতে লেখক অনেক নারীর অন্তর্দহনের কথাই বলেছেন সুনিপুণভাবে।
মন হাহাকার করা আরেকটি গল্প হলো “সাং বেতুয়ান”। জন্মভিটার মায়া ছেড়ে, দেশের মাটি মায়া ছেড়ে যখন স্বেচ্ছায় নয়, বরং বাধ্য হয়ে পাড়ি দিতে হয় ভীনদেশে, সেই ছাড়াছাড়ির নেপথ্যের মর্মন্তুদ যাতনার কথা যদি জানতো মানুষ! যদি বুঝতো কেমন মড়মড় করে বুকের পাঁজর ভেঙে যায়! পরেশের অরুণ কাকার জন্মভিটা ছেড়ে চলে যাওয়া, মালোপাড়ার আগুন লাগা, সয়ফলের লোভের গুড়িতে বালি পড়ে যাওয়ার উপক্রমে ধৈর্যচ্যুত গোপন দ্বেষ উগড়ে পড়ে,” শ্যাষ কথা কইয়া দে পরেশ। তোর পিছে আর লাট্টুর লাকান ঘুরবের পারব না শালা মালুর বাচ্চা…..”। সামপ্রদায়িকতার জের কিভাবে এখনো টেনে যাচ্ছি আমরা সেই ভয়ংকর রূপ নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়ে যায় এই গল্পে।
বইয়ের নাম গল্পটিতে এসে আমরা দেখব আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র। আমাদের সরকারের বিভিন্ন পদে বহাল কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সেবাচিত্রের নমুনা। তৌকির আহমেদের “অজ্ঞাতনামা” চলচ্চিত্রে ঠিক এরকম কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল।
ভারতীয় সীমানার কাঁটাতারের পাশে পড়ে থাকা একটি হাতির মৃতদেহ দেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই মূলত মেনকি ফান্দা গ্রামের লোকজনের কথাবার্তার ভেতরই লুকিয়ে থাকে অপরাধ কিংবা পাপের হিসাব নিকাশ। “মরা আতি লাখ ট্যাহা। মরা মানুষ দশ হাজার ট্যাহা।” এই দুটি বাক্য দিয়েই কত কথা বলে দেয়া যায়!
অনেক কথা বলেও দেয় সদ্য কন্যা হারানো পিতা নেয়ামত। গল্প থেকে একটু পড়ি “পাঁচ মাস আগে এই গ্রামেরই একটা গাছের ডালে নেয়ামতের মেয়ে কলির লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। নেয়ামত অভিযুক্তদের সঙ্গে আপোস করেছিল। শেষ পর্যন্ত তাকেও প্রভাবশালীদের চাপে ধর্ষণসহ হত্যা মামলায় আত্মহত্যা মর্মে তদন্ত রিপোর্ট দিতে হয়েছিল। মিজান দারোগা নেয়ামতকে ধমক দিতে গিয়েও থমকে যান। কলি হত্যা মামলায় তিনি যা করেছিলেন সেটা কি অপরাধ? না পাপ?”
অপরাধ কিংবা পাপের এই হিসাব নিকাশের ফলাফল হিসাবে কোনো স্থির বিন্দুতে পৌঁছাতে পারে না মিজান, জহির মেম্বার, মানিক, কাশেম থেকে শুরু করে মেনকি ফান্দার গ্রামের সকল মানুষ। পৌঁছাতে পারি না আমরাও।
১৭ টি গল্প আছে “মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ” গ্রন্থটিতে। জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে যে গল্পে সেটাই তো মানবিক গল্প। চলমান সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে, চলমান জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করে বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে গল্প লেখেন গল্পকার সাদিয়া সুলতানা। তার গল্পে আছে ভাবনার রসদ। সহজ ভাষায় লেখা তার প্রতিটি গল্পের সাথে খুব সহজেই একাত্ম হওয়ার সুযোগ রয়েছে পাঠকের।
গল্পকারকে ধন্যবাদ।
বইটির প্রচ্ছদও দারুণ সুন্দর। ধন্যবাদ প্রচ্ছদ শিল্পীর প্রতিও।