সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বৈদ্যুতিক ফাঁদ

লামায় ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা

লামা প্রতিনিধি | সোমবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালীর বনাঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য বৈদ্যুতিক ফাঁদ। বন্য হাতির আক্রমণ থেকে নিজেদের জান-মাল, ক্ষেতের ফসল ও ফলদ-বনজ বাগান রক্ষায় পাতা হচ্ছে এ ফাঁদ। বাড়ি কিংবা ফসলের ক্ষেতের চারপাশে তার দিয়ে ঘেরা করে সেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে এ ফাঁদ তৈরি করা হয়। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রতিনিয়ত আহত ও নিহত হচ্ছে মানুষ, হাতিসহ বিভিন্ন পশু-পাখি। ফলে হাতি তাড়ানোর ফাঁদ তৈরি হচ্ছে মরণ ফাঁদে। এ সকল ফাঁদে হতাহতের ঘটনা ঘটলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো ধামাচাপা দিয়ে হৃদরোগ বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই এ সকল ফাঁদ হাওয়া হয়ে যায় বলেও অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন।
বন্য হাতির খাবার, আবাসস্থল এবং চলাচলের পথ সংকুচিত হওয়ায় মানুষ এবং হাতির মধ্যে নীরব লড়াই চলে আসছে বছরের পর বছর। হাতি ও মানুষের মধ্যকার এ লড়ায়ে গত ৩ বছরে নিজেদের পাতা ফাঁদে মৃত্যু হওয়া দুজনসহ কম পক্ষে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক। এ সময় বৈদ্যুতিক ফাঁদসহ বিভিন্ন কারণে শিশু হাতিসহ ৪টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
লামা বনবিভাগ সূত্র জানায়, লামা বনবিভাগের ৬টি রেঞ্জের আওতায় ১ লাখ ২ হাজার ৮৫৪ একর মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ১৯ হাজার ১৩৫ একর ৬ ধারা ঘোষিত বনাঞ্চল এবং ২ হাজার একর অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল রয়েছে। এ সকল বনাঞ্চলে দুটি দলে ২৫/৩০ টি হাতি আসে। এ সকল হাতিগুলো চুনতি রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে লামা, ফাঁসিয়াখালী, সরই, আজিজনগর, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, চকরিয়া ফাঁসিয়াখালী, ঈদঘর, উখিয়া টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করে থাকে। আগে বছরের একটা সময় এ সকল হাতি মায়ানমার থাকলেও সীমান্তে কাটা তারের বেড়া দেয়ায় হাতিগুলো সেদিকে আর যেতে পারছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ে ঝুম চাষের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস করা, হাতির আবসস্থল ও করিডোরে চাষাবাদ এবং জনবসতি গড়ে তোলায় খাদ্য সংকটে প্রায়শই হাতি ও মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে।
লামা ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের (ইআরটি) সাধারণ সম্পাদক মো. ছানাউল্লাহ্‌ বলেন, আগে মানুষ আগুন জ্বালিয়ে, বাজি ফুটিয়ে এবং সবাই মিলে হই-হুল্লোড় করে হাতি তাড়াতো। এখন দিন দিন মানুষ বিবেকহীন হয়ে পড়ছে। তারা হাতি তাড়াতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দিচ্ছে। সে ফাঁদে মানুষ, গরু, ছাগল ও পাখি নির্বিচারে মরছে। নিজেদের বাড়ি, ফসল, কিংবা ফলদ-বনজ বাগানের চারপাশে জিআই তার দিয়ে ঘোরাও করে রাখেন। সন্ধ্যার পর এ সকল তারে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেন। সকালে আবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। অনেক সময় এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা মনে থাকে না। এতে করে নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে মরছেন। অনেকে মারা গেলে তাৎক্ষণিক এ সকল ফাঁদ লুকিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া কিংবা অন্য কোনো ভাবে মারা যাওয়ার নাটক সাজান। তিনি বলেন, কোনো কৃষকের ১০ হাজার টাকার ফসল নষ্ট হলে বনবিভাগের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে ২০/৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পান। তারপরও তারা অমানবিকভাবে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতেন। এতে করে হাতি মারা যাচ্ছে কিংবা আহত হয়ে পরবর্তীতে মরছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের খালখুইল্যা পাড়া, রাঙ্গাঝিরি, চাককাটা, বড় ছনখোলা, কুমারী, বিচুইন্না, ফুটের ঝিরি, বাম হাতির ছড়া, ডান হাতিরছড়া, পাঁচ মাইল, জলপাইতলী, হাইদারনাশী, কবিরার দোকান, ইয়াংছা, ঘিলাতলী, কুরুপপাতা ঝিরি, বগাইছড়ি ও অংসারঝিরিসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে দেয়া হয় অসংখ্য বৈদ্যুতিক ফাঁদ। এ সকল ফাঁদে গত ২০২০ সালের জুন মাসে ফাঁসিয়াখালীর ফাইন্না ঝিরি এলাকায় আব্দুর রহিম (২১), গত ৩০ আগস্ট ফুটের ঝিরি এলাকায় মো. ইলিয়াছের (৪০) মৃত্যু হয়।
লামা বন বিভাগের প্রধান সহকারি কাজী মো. গোলম ছরোয়ার জানান, বন্য হাতির আক্রমণে নিহত, আহত ক্ষতিগ্রস্থদের সরকার বনবিভাগের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। তিনি জানান, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৬ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ২৩ লাখ ২২ হাজার টাকা, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৪৭ জনের ফসলের ক্ষতি বাবদ ৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
লামা বন বিভাগের সদর রেঞ্জ অফিসার মো. আতিকুল ইসলাম জানান, হাতি হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা চলমান রয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আমরা ইআরটি সদস্যদের নিয়ামিত প্রশিক্ষণ প্রদান করছি।
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, শুধু মাত্র সচেতনতা সৃষ্টি করে নয়, বৈদ্যুতিক ফাঁদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমেই বন্য হাতির উম্মুক্ত চলাচল পথ নিশ্চিত করা সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৮ দিনে ২৩৬ কন্টেনার পণ্য ধ্বংস করলো কাস্টমস
পরবর্তী নিবন্ধআজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের সাথে পেয়ারুল ইসলামের সাক্ষাৎ