সংগ্রাম গৌরব ও ঐতিহ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

মো. মোরশেদুল আলম | বুধবার , ২৩ জুন, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

ঐতিহাসিক ২৩ জুন। এদেশের বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন কাজী বশিরের স্বামীবাগস্থ বাসভবন ‘রোজ গার্ডেনে’ অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে দলটি পূর্ববাংলার একক ও নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালে দলীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত দীর্ঘ ৯ মাসের বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লক্ষেরও অধিক শহিদের রক্ত এবং ৩ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম হানির বদৌলতে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধু সবসময় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক মুক্তি দিয়েছেন, আর বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দিয়েছেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ দমনে দৃশ্যমান ভূমিকা আজ বিশ্বসমাদৃত। আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালিত পরিবেশ সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিনিয়োগ বিকাশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বপরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
২০১৮ সালের আগস্টে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর ঘোষণা করেছিলেন, দেশটিকে তিনি সুইডেনের মতো উন্নত দেশে পরিণত করবেন। তার সেই অতি উচ্চাভিলাষী মনোভাবের প্রতিক্রিয়ায় এক পাকিস্তানি সাংবাদিক টেলিভিশনের টকশোতে তাদের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তিনি যাতে সুইডেনের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করেন। সেই সাংবাদিক আরও বলেছিলেন, খান সাহেব যদি দেশটির সকল সমস্যা দূর করতে আদৌ সমর্থ হন এবং প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে উন্নীত করতেও পারেন, তাহলেও বাংলাদেশের সমকক্ষ হতে পাকিস্তানের দশ থেকে বারো বছর সময় লাগবে।
২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় সে দেশের পদার্থবিজ্ঞানী পারভেজ হুদভয় লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের বিশাল আত্মসমর্পণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের নম্র আচরণ করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্ব যখন সম্পূর্ণ তিরোহিত, সে সময় এমনকি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও এই তত্ত্বের ভাবনাটি পরিবর্তনের ব্যাপারে ছিল নারাজ। দেশের পশ্চিমাংশ নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান করা হয় বটে, তবে অনেকেই ভেবেছিল এটা সাময়িক। তারা বলেছিল, বাংলাদেশ কখনোই অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারবে না এবং বিনীতভাবে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করবে।’ পাকিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির তুলনা করে উপসংহারে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ অন্তর্কলহে বিবদমান। তবু, অনেক বেশি বিচিত্র সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ও উদার, দেশটির সুশীল সমাজ এবং সক্রিয় বুদ্ধিজীবীসমাজ কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর লাগাম ধরা বন্ধ করেছে।…নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে দায়বদ্ধ নেতারা অস্ত্র কিংবা বিশাল সামরিক স্থাপনার পরিবর্তে বাধ্য হয়েছেন মানবসম্পদে বিনিয়োগ করতে।’
২০২১ সালের ৩ মার্চ ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং ভিয়েতনামে বিভিন্ন পর্যায়ের সফল উন্নয়ন মডেলের নিকটতম প্রতিনিধি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য একটা নাম।’ ২০২১ সালের ১০ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা প্রদত্ত ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সুষমভাবে বেড়েছে, বর্তমান অতিমারির আগে চার বছর ধরে দেশটির অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে, চীনের চেয়ে দ্রুতগতিতে। পত্রিকাটির মতে, বাংলাদেশের এই গোপন রহস্য হচ্ছে, শিক্ষা এবং বালিকারা। বাংলাদেশ যখন তাদের মেয়েদের শিক্ষিত ও ক্ষমতায়ন করেছে, সেই শিক্ষিত নারীরা পরিণত হয়েছে দেশের অর্থনীতির স্তম্ভে। পত্রিকাটি আরও বলছে, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দারিদ্র্য হ্রাস করার এক অনুপ্রেরণার কাহিনি হিসেবে অভিহিত করে। বাংলাদেশকে বছরে কত সহায়তা দেওয়া হবে, তা নিয়ে একসময় দাতারা বছরে একবার বৈঠক করত, যা প্যারিস কনসোর্টিয়াম নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে প্রথম বৈঠক হয়। এরপর প্রতিবছর বাজেটের আগে এপ্রিল ও মে মাসে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরা চাহিদার ফর্দ নিয়ে ওই সব বৈঠকে যোগ দিতেন। দাতাগোষ্ঠীর নানা শর্ত মেনেই টাকা নিতে হতো। কিন্তু এখন চিত্র উল্টো। চাহিদা শুনতে দাতারাই বাংলাদেশে আসেন। প্যারিস কনসোর্টিয়ামের পরিবর্তে বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
একসময় পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাসনিম সিদ্দিকী এক নিবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যাধিক্য, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, ক্ষুধা এবং অবকাঠামোর অভাব যে কোনো সরকারের জন্য একটা ভীতিকর চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেশটির অর্থনীতি ভারত ও চীনকে পেছনে ফেলে গত বছর ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। রপ্তানি (২০১৮-১৯) চার হাজার কোটি ডলার ছুঁয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের তুলনা করে তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? তিন-চার বছরের উচ্চ প্রবৃদ্ধির একটা আপাতদৃষ্ট চক্রের পর আমরা আবার আগের জায়গায়।…আমাদের রপ্তানি দুই হাজার ৫০০ কোটি ডলারে আটকে আছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দেনা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে (সূত্র: স্টেটসম্যান, ২০ ডিসেম্বর ২০২০)।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে এ দেশের ৭৮ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করত, এখন তা ৩০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চপ্রবৃদ্ধির হার ধরে রেখেছে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র রচিত হয়েছে। সত্তর দশকে আমদানি ও রপ্তানি মিলিয়ে বহিঃবাণিজ্য যেখানে মোট দেশজ উৎপাদনের মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ ছিল, নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে তা এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৪৩ ভাগে। গত তিন দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় গড়ে বার্ষিক শতকরা ১২ ভাগ হারে বেড়েছে। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ এখন তৈরি পোশাক শিল্প থেকে আসে।
প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি ও তার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার বাড়ায় বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা অনেকটা কমে এসেছে। বাংলাদেশ আজ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ, এখন তা শতকরা ২ ভাগে নেমে এসেছে। মানবসম্পদ উন্নয়নেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ অনেকক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ততা এখন অনেক বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছে। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি ক্ষেত্রে এদেশের নারী সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জনগণের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও খাদ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
নারীর ক্ষমতায়ন, শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস প্রভৃতি কারণে বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। সরকারি, বেকসরকারি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের সমীক্ষায় উঠে আসা বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা করা না হত এবং আওয়ামী লীগ যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকত; তাহলে আশির দশকেই বাংলাদেশ হত উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ হতে পারত উচ্চ আয়ের দেশ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধকুতুবুল আউলিয়া সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহ.)