কুতুবুল আউলিয়া সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহ.)

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান | বুধবার , ২৩ জুন, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বিন, আধ্যাত্মিক জগতের সু-উচ্চ মকামের অধিকারী, মুর্শিদে বরহক হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ.) এর ৬২তম সালানা ওরছ মুবারক আজ। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ওরশ উদযাপিত হবে।
পাকিস্তানের হাজারা জিলার হরিপুর (সেতালু শরীফ) ছিরিকোট এর নবী বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্‌ ছিরিকোটি (রহ.)। জন্ম সূত্রে তিনি হযরত সৈয়দ ইমাম হোসাইন (রা.) এর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ হযরত সৈয়দ জালাল আর রিজাল (রা.) এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
বৃটিশ ভারতের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৭ হিজরীর (১৮৮০ সালের কোন এক তারিখে) শাবান মাসে তাঁকে ‘মমতাজুল মুহাদ্দেসীন’ সনদ প্রদান করে দস্তারে ফজিলত প্রদান করা হয়। শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি আপন মাসওয়ানী সৈয়দ বংশের এক বিদুষী মহিলা সৈয়দা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পূর্ব পুরুষের অনুসরণে কিছুদিনের মধ্যে ইসলাম প্রচারের মহৎ উদ্দেশ্যে দঃআফ্রিকা গমন করেন। কেপটাউন, জাঞ্জিবার, মোম্বাসা প্রভৃতি এলাকায় তিনি ব্যবসা করার সাথে সাথে ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন। চরম বর্ণবাদের শিকার বহু কালো মানুষ হজুর কিবলার হাতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ঐতিহাসিকদের মতে, একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে (সিরিকোটি (রহঃ) ইসলাম প্রচার ও মসজিদ নির্মাণের উদ্যোক্তা ছিলেন।
তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করে (১৯১১-১২ই ইংরেজী) হরিপুর বাজারে কাপড়ের দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন পর তিনি একদিন চৌহর শরীফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। চৌহরভী (রহ.)‘র হুজরার সন্নিকটে একজন নূরানী চেহারার ব্যক্তির সাথে দেখা হলে সিরিকোটি (রহ.) ঐ ব্যক্তির নিকট খাজা আবদুর রহমান (রহ.)’র অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ভদ্রলোক উল্টো বললেন : ও তাহলে তুমি এসে গেছো, স্ত্রী সাহেবান পাঠিয়েছেন তোমাকে। গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী সিরিকোটি (রহ.) না বলা কথা ফাঁস করে দেয়ার মতো অদৃশ্য জ্ঞানের এ মানুষটিই একজন কামেল পুরুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ কথা ভাবতে না ভাবতেই বৃদ্ধ লোকটি কাল বিলম্ব না করে বললেন, ‘তিনিই খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী’। ক্ষণিকের সংক্ষিপ্ত কথোপকোথনে পরস্পরের মধ্যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হলো, একদিকে এলমে লুদুন্নীর প্রস্রবণ “আল্লাহ প্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞানের ভান্ডার” অপরদিকে জাহেরী ইলমের জ্ঞানের ভান্ডার।
সিরিকোটি (রহ.) হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভীর (রহ.) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে মুর্শিদের খেদমতে সমর্পিত হয়ে গেলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই মুর্শিদ মুরীদ মাওলানাকে লঙ্গরখানার জন্য বন থেকে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসার হুকুম করলেন, মাওলানা সাহেব নির্বিকার, নির্দেশ পালনে বদ্ধপরিকর। কারণ এ কাজের মধ্যে নিহিত রহস্যের কথা হুকুমদাতা ও নির্দেশ পালনকারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্তরের অন্তরাত্মার তার বিহীন সংযোগে তোলপাড় শুরু হয়। পাথুরে পাহাড়ে কাঠ পাওয়া যায় না বিধায় বহুদূর হতে কাঠ সংগ্রহ করে বহু বছর পর্যন্ত সিরিকোটি (রহ.) হুকুম পালন করেছেন। একদিন অকস্মাৎ পীর সাহেব কেবলা কাঠ সংগ্রহ বন্ধ করার আদেশ দিলেন। সিরিকোটি (রহ.) হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমুঢ়। মুরীদের নিবিষ্টমনের খেদমতে মুর্শিদ প্রফুল্ল চিত্তে এ নির্দেশ প্রদান করেছেন, তা পরবর্তী নির্দেশনায় পরিস্ফুট হয়েছে। যথারীতি খেলাফত প্রদান করে বার্মার রাজধানী রেংগুন (ইয়াংগুন) গিয়ে দ্বিন ইসলামের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রিয় মুরীদ সিরিকোটি (রহ.) নির্বিধায় নিশ্চিন্ত মনে পীরের নির্দেশ শিরোধার্য করে অচেনা-অজানা গন্তব্যস্থান চার হাজার মাইল দূরের রেংগুনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান পরিবার সংসার চেনাজানা সকলকে অবাক করে।
রেংগুনে পৌঁছে বাঙালি মসজিদে পেশ ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব নিয়ে দ্বিন ইসলাম মজহাব, মিল্লাত ,শরীয়ত, তরীকত ভিত্তিক ওয়াজ- নসিয়ত শুরু করেন। পান্ডিত্যপূর্ণ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণধর্মী বয়ান মুসল্লীদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লীরা হুজুরের ইমামতিতে নামাজ আদায় ও ইসলামী বয়ান শোনার জন্য জমায়েত হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। পীরের তাওয়াজ্জুহ পাওয়া নবী সন্তান সৈয়দ আহমদ শাহ (রহ.)’র অনেক কেরামত সে-সময়ে প্রকাশ পায়। মুসল্লীদের বাইয়াত হবার জন্য পুনঃপুনঃ আবেদন-অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে এর একটা সমাধান দেয়ার জন্য পীরের (চৌহরভী (রহ.) নিকট পত্র লেখেন সিরিকোটি (রহ.)। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রহ.) একখানা রুমাল সমেত পত্রোত্তরে সৈয়দ আহমদ শাহ কে রুমালের এক প্রান্ত নিজ হাতে ও অপর প্রান্ত মুসল্লীদের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে মাশায়েখ কেরামের পক্ষ হতে প্রদত্ত ছবক সহকারে বাইয়াত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। খেলাফত পেলেই বাইয়াত করানো যায়না, যতক্ষণ মুর্শিদের হুকুম না হয়।
শত শত সরলপ্রাণ মুসলমান হুজুরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ধন্য হন। ইতোমধ্যে হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রহ.) পত্র সমেত ত্রিশপারা দরুদ সম্বলিত মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রছুল (দ.) শিরোনামের একটি অমূল্য ও অদ্বিতীয় গ্রন্থ সিরিকোটি (রহ.) এর নিকট পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন রেংগুনের ভাইদের সহায়তায় ছাপিয়ে মখলুকাতের উপকারার্থে প্রচার করা এবং সাথে সাথে হরিপুরস্থ দারুল উলূম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার দ্বিতল ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য একটি কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়ে সতর্ক করেন যে, যতোদিন এ ২টি কাজ সম্পন্ন না হবে ততোদিন সিরিকোটি (রহ.) রেঙ্গুন ত্যাগ করতে পারবেন না। এ কাজসমূহ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১৬ বছর সৈয়দ আহমদ শাহ (রহ.) রেংগুন ছেড়ে যাননি পীরের নির্দেশের কারণে।
চট্ট্রগ্রামের অসংখ্য লোক জীবিকার তাগিদে সে সময় রেংগুন অবস্থান করার কারণে হুজুরের মুরীদানের মধ্যে চট্টগ্রামে আধিক্য রয়েছে। হুজুরের খলীফা মাষ্টার আবদুল জলিল (বি,এ) ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আবদুল খালেক, সুফী আবদুল গফুর, মাওলানা এজাহারুল হক সহ অসংখ্য পেশাজীবী হুজুরের মুরীদ হয়ে ধন্য হন। উল্লিখিত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিগণের অনুরোধে পেশোয়ার হতে রেংগুনে যাতায়াত পথে ১৯৩৬ সাল হতে মাঝে মধ্যে স্বল্প সময়ের জন্য চট্টগ্রাম অবস্থান করতেন হুজুর কিবলা।
১৯৪১সালে সুদীর্ঘ ২১ বছর রেংগুনে শরিয়ত-তরিক্বতের খেদমত করার পর হুজুর স্বদেশে ফিরে যান। প্রতি বছর চট্টগ্রাম সফর করেন তখন থেকেই। ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আব্দুল খালেক (হুজুরের খলিফা)’র কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেস এর ওপরে হুজুর কেবলার খানকা শরীফ স্থাপিত হয়। এখান থেকেই হুজুর কেবলা শরিয়ত ও তরিক্বতের প্রচার-প্রসারের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর হুজুর কেবলা বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখিলে এক ওয়াজের দাওয়াতে গিয়ে ওয়াজ শুরু করলে সফরসঙ্গী ব্যতিত অন্য কেউ দুরূদ পাঠ করলোনা দেখে হুজুর কেবলা খুবই রাগান্বিত হন। পরদিন চট্টগ্রাম শহরে ফিরে এসে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করার জন্য পীর ভাইদের নির্দেশ দেন। হুজুর বলেন কাম করো, ইসলামকো বাঁচাও, দিনকো বাঁচাও, সাচ্ছা আলেম তৈয়ার করো।’ জমির ব্যাপারে বল্লেন শহর ভি না হো, গাঁও ভি না হো, লেকিন শহর-ছে দূর ভি না হো। মসজিদ ভী হু, সাথ তালাব ভী হু’’ অনেক জমি দেখার পর বর্তমান জামেয়ার অবস্থানের এই জমিটুকু হুজুর কেবলার পছন্দ হয়। হুজুর বলেন এই জমি হতে ইলমের খুসবু আসছে। ১৯৫৪ সালে এই জমিতে হুজুর কেবলা জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ভিত্তি স্থাপন করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠালগ্নে হুজুর কেবলা কিছু নসিয়ত করেন। ইয়ে জামেয়া কিস্‌তিয়ে নুহ্‌ (আলায়হিস্‌ সালাম) হ্যায়। এই মাদ্রাসার খেদমত যারা করবে তারা ঐ কিস্তির আরোহীর মত মুক্তি পাবে। ‘মুঝে দেখনা হ্যায়তো, মাদ্রাসাকো দেখো’, ‘মুঝছে মহব্বত হ্যায়তো মাদ্রাসাকো মহব্বত করো’। ‘মাদ্রাসাকে লিয়ে মান্নত করো। মান্নত পুরা হোনেছে মান্নত পুরা করো’। মসলকে আ’লা হযরতের আক্বিদার উপর এই মাদ্রাসার ভিত্তি দেয়া হলো। এখানকার শিক্ষার্থীরা দেশ-দেশান্তরের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামারে পক্ষে জিহাদ করে যাচ্ছে অদ্যাবধি। ১৯২৫ সালে আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়াও প্রতিষ্ঠা করেন রেঙ্গুনে। ১৯৫৫ সালে নাম পরিবর্তন করে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া নামকরণ করা হয় সংগঠনটির।
১৯৫৮ সালে হুজুর কেবলা শাহজাদা সৈয়দ মুহাম্ম তৈয়ব শাহ্‌ (রহ.)’র ও দৌহিত্র হুজুর সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ্‌ (মা.জি.আ.) কে নিয়ে চট্টগ্রামে তশরিফ আনেন। এটাই ছিলো হুজুর কেবলার শেষ সফর। প্রায় ৭ মাস অবস্থান করার পর হুজুর কেবলা ১৫-২০ জনের কাফেলা নিয়ে পবিত্র হজ্ব সমাপনান্তে মক্কা শরীফ যাত্রা করেন স্টিমারযোগে। হযরত তৈয়ব শাহ্‌ (রহ.) পাকিস্তান ফিরে যান। হজ্ব শেষে হুজুর কেবলা নাতি হযরত তাহের শাহ্‌ (মা.জি.আ.)’কে নিয়ে স্বদেশ ফিরে যান। চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। ১৯৬০ সালে ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আব্দুল খালেক, আলহাজ্ব নুর মুহাম্মদ আল-কাদেরী, আলহাজ্ব ডাঃ টি হোসেন, হাজী আবুল বশর, আলহাজ্ব আমিনুর রহমান সওদাগর, আলহাজ্ব আকরাম আলী খাঁন, আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম সওদাগর ও ফজলুর রহমান হুজুরকে আনতে সিরিকোট শরীফ যান। এদের পূর্বে আলহাজ্ব ওয়াজের আলী সওদাগর আল-কাদেরীও পেশওয়ার গিয়েছিলেন। হুজুর ভাইদের বলেছিলেন, হযরত কেরামছে হুকুম মিলনেছে জরুর জাউংগা, ‘লেকেন জানে কো হুকুম নেহি হ্যায়’ অনেক কান্নাকাটি করে ভাইয়েরা চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। এটাই ছিলো হুজুর কেবলার আখেরী বয়ান। ১৯৬১ সালের ২ মে তৎকালীন আনজুমান ট্রাস্ট সেক্রেটারী আলহাজ্ব আবু মুহাম্মদ তবিবুল আলম সিরিকোট শরীফ গমন করেন। হুজুর তখন খুবই অুসস্থ ছিলেন। সে সময় হুজুর কেবলা তবিবুল আলম সাহেবকে খেলাফত প্রদান করেন। যা স্বাক্ষর করেন সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্‌ (রহ.)। ২১ মে জোর করে হুজুর কেবলা তাকে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেন। ২২ মে মোতাবেক ১১ জিলক্বদ লক্ষ-লক্ষ পীর ভাইদের শোক সাগরে ভাসিয়ে হুজুর কেবলা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যে চলে যান।

লেখক : প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাষ্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংগ্রাম গৌরব ও ঐতিহ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
পরবর্তী নিবন্ধহেফাজতের ১৯ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এমপির মামলার আবেদন খারিজ