সংকটে বিআইডব্লিউটিএ

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১৩ জুন, ২০২৩ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

ভয়াবহ রকমের দুরবস্থায় পড়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। দেশের কোটি কোটি টাকার পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজসহ চট্টগ্রাম থেকে অভ্যন্তরীণ নৌরুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটি রকমারি সংকটে ডুবে রয়েছে। প্রয়োজনের এক চতুর্থাংশেরও কম পাইলট দিয়ে চলছে সংস্থাটি। বয়া স্থাপনের প্রকল্পও ঝুলে রয়েছে। কমে গেছে বয়া সংস্কারের বাজেটও। সবকিছু মিলে আর্থিক এবং লোকবল সংকটে চট্টগ্রাম অঞ্চল মূলতঃ ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারে পরিণত হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতের জন্য বিআইডব্লিউটিএ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বছরে দশ কোটি টনেরও বেশি পণ্য পরিবাহিত হয়। চালডালসহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্য, সার, ক্লিংকার, পাথরসহ নানা ধরনের পণ্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, বাঘাবাড়ি, নগরবাড়ি, নোয়াপাড়া, বরিশাল, খুলনা, মংলা, চাঁদপুর, ঘোড়াশালসহ দেশের নানা স্থানে পরিবহন করা হয়। অয়েল ট্যাংকারগুলো চলাচল করে চাঁদপুর, বরিশালসহ নানা রুটে। পণ্যবাহী লাইটারেজ জাহাজ এবং জ্বালানি তেলবাহী অয়েল ট্যাংকার মিলে দেড় হাজারেরও বেশি জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে পণ্য বোঝাই করে বিআইডব্লিউটিএর কাছে মাস্টার পাইলট বুকিং দেয়। পাইলট জাহাজগুলোকে চট্টগ্রাম থেকে পঞ্চাশ নর্টিক্যাল মাইলের মতো নিয়ে লক্ষীপুরের চরগজারিয়া এলাকার আজাদ বাজারে পৌঁছে দেয়। আজাদ বাজারে একটি পাইলট হাউজ রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া পাইলটেরা ওখানে গিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পাইলট হাউজে অবস্থান করেন। ফিরতি পথের অপর জাহাজের পাইলট হিসেবে এসব মাস্টার পাইলট আবারো চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। চট্টগ্রামে বিআইডব্লিউটিএর ১২০ জনের মতো পাইলটের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখানে পাইলট রয়েছেন মাত্র ২৪ জন। জাহাজ যাত্রার আগে মাস্টার পাইলটের উপস্থিতি নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে প্রতিটি লাইটারেজ জাহাজ পাইলট নিয়ে থাকে। মাস্টার পাইলট ছাড়া লাইটারেজ জাহাজের কর্ণফুলী নদীর মোহনা অতিক্রমে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ চট্টগ্রামে বিআইডব্লিউটিএর কাছে পর্যাপ্ত পাইলট না থাকায় লাইটারেজ জাহাজগুলোকে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়। অনেক সময় পাইলট না নিয়ে জাহাজগুলো চলাচল করে। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম বিআইডব্লিউটিএ পাইলট খাত থেকে বছরে অন্তত দশ কোটি টাকার মতো আয় করে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ ড্রাফটসহ নানা বিষয় নির্ধারণ করে দেয়। নদীর চ্যানেল কিভাবে নির্ধারিত হবে, কোথায় কতটুকু ড্রাফট আছে, কোন দিকে চলাচল করার মতো পর্যাপ্ত পানি আছে, কোন দিকে চর আছে ইত্যাদি ব্যাপারগুলো বিআইডব্লিউটিএ জানে এবং সেভাবে জাহাজ চলাচলের গতিপথ ঠিক করে দেয়। কিন্তু সংস্থাটি অর্থ এবং লোকবলের অভাবে লাইটেড বয়া এবং লাইটেড বিকন স্থাপন, স্থানান্তর, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতের কাজ করতে পারছে না। এতে জাহাজ দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে নদীপথে ঝুঁকিও। একটি বয়ার অভাবে জাহাজ ভুল পথে গিয়ে সাগরে নিমজ্জিত হওয়া কিংবা চরের সাথে ধাক্কা খেয়ে আটকে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। রাতের বেলায় অথৈ নদীতে বয়া এবং বিকনগুলো জাহাজের নাবিকদের পথ দেখায়। কিন্তু বর্তমানে বয়া মেরামত এবং স্থাপনের কাজ অর্থাভাবে সংকটে পড়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে আজাদবাজার পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএর ১৭টি বয়া রয়েছে। এছাড়া ১০টি বিকন রয়েছে। বয়াগুলো থেকে আলো জ্বলে। আর বিকন থেকেও আলোকরশ্মি বের হয়। কিন্তু নদীর পানিতে ভাসমান এসব বয়া এবং বিকন বিভিন্ন সময় নষ্ট হয়ে যায়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বয়া মেরামত কিংবা নতুন বয়া স্থাপন বা স্থানান্তর করতে হয়। এ জন্য চট্টগ্রাম বিআইডব্লিউটিএর কাছে ধ্রুবতারা নামের একটি জাহাজ ছিল। ওই জাহাজটি দিয়ে বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশলীরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বয়া এবং বিকন মেরামতসহ প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করতেন। কিন্তু তেলের অভাবে এই জাহাজের চলাচলও এক সময় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পরবর্তীতে জাহাজটি নারায়নগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলেও আর ফেরত আসেনি। বর্তমানে কোথাও বয়া বা বিকন নষ্ট হলে চট্টগ্রাম বিআইডব্লিউটিএ ঢাকায় খবর পাঠায়। পরে ওখান থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন এবং জাহাজের তেল পাওয়া গেলে নষ্ট বয়া এবং বিকন মেরামত হয়। অন্যথায় বয়া এবং বিকন অচল থাকে। বয়া এবং বিকন মেরামতের বাজেট কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এতে করে নদীপথে বয়া ও বিকনগুলো প্রায়শঃ কাজ করে না। চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বয়া সংস্কার এবং বাড়তি বয়া স্থাপনের দাবি জানানো হলেও তা ঝুলে আছে।

গতকাল বিআইডব্লিউটিএর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সংকটের কথা স্বীকার করে বলেছেন, আমরা ঢাকায় বিষয়গুলো জানিয়েছি। প্রকল্পও দিয়েছি। কিন্তু অর্থের যোগান বা প্রকল্প অনুমোদন না পেলে আমাদের তো কিছু করার থাকে না। তিনি সংস্থাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করে এক্ষেত্রে আরো মনযোগ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবরিশাল ও খুলনা সিটি নির্বাচনে নৌকার জয়
পরবর্তী নিবন্ধএস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের সাথে ‘প্রতারণা’, গ্রেপ্তার ১