পর–পর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনাগুলো আবার উল্লেখ নাইবা করলাম। এর প্রেক্ষিত সচেতন মানুষ মাত্রেই বলছেন–দেশে ‘চরম রুচির সংকট’ চলছে। কেউ কেউ এটাকে ‘সভ্যতার সংকট’ বলছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে নির্মম রসিকতা করছেন। নির্মম শব্দটা ব্যবহার করলাম একটা গল্প মনে পড়ে যাওয়ায়। গল্পটা প্রাচীন। নীতিশিক্ষামূলক গল্প হিসেবে পরিচিত। ঈশপের গল্পে এটি আছে। গল্পের সারাংশ এইরকম, এক গ্রামে এক পুকুর ছিল। সেই পুকুরে বাস করত কিছু ব্যাঙ। একদিন কিছু বালক মিলে খেলার অংশ হিসেবে সেই পুকুরে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করল। ব্যাঙরা মারা যেতে থাকল ঢিলের আঘাতে। বালকদের ঐদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তারা মজা পাচ্ছিল। অতপর, এক বুড়ো ব্যাঙ পানির নিচ থেকে মাথা তুলল। বালকদের বলল, প্রিয় বালকবৃন্দ, তোমরা খেলছ জানি। কিন্তু যা তোমাদের কাছে মজার খেলা, তা আমাদের জন্য মৃত্যুর কারণ। রসিকতা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ কল্পে পাঠকের জানা গল্পটা আবার উল্লেখ করলাম।
বিরত তো করলাম। করণীয় কী? করণীয় হলো সংকটের গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করা। উত্তরণের উপায় নিরূপন করে উদ্যোগ গ্রহণ করা। কাজটা হচ্ছে না। সবাই শুধু গেল গেল বলে চিৎকার করছি। কী গেল, কেন গেল, কী করে গেল সেসব আর খোঁজ করছি না। এক্ষেত্রে একটা দল আবার সরকারকে দায়ী করছেন। হ্যাঁ মানছি। অবশ্যই সরকারের দায় আছে। দায়িত্বও আছে। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে, সমাজের সচেতন প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কি দায় নেই? আমাদের কি দায়িত্ব নেই? তা কি আমরা পালন করছি?
সংকটটা হাল আমলের নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধখানা সে কথা প্রমাণ করে। উনবিংশ শতকে তিনি এ কথা বলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল আশি বছর। তারপর আবার বললেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। তিনি বললেন, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’। তাও নাকি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় আগে। ‘সভ্যতার সংকট’ কিংবা ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ যে নামেই সম্বোধন করি না কেন, প্রাচীন এ সমস্যা বা সংকটকে আমার কাছে ‘সংস্কৃতির সংকট’ বা ‘সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ’ বলে মনে হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহিত্যিক আবুল ফজল প্রমুখরা ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন করেছিলেন। সে আন্দোলন এখন আর নেই। এখন খেলাঘর আন্দোলন মৃতপ্রায়। কোথায় শাপলা কুঁড়ির আসর? কোথায় কচি কাঁচার আসর? এসব সংগঠনই সেদিন আধ মরাদের ঘা মেরে জাগাত। এখন জাগায় না। তাই এতসব অনাসৃষ্টি। এখানেই ব্যক্তি পর্যায়ের দায় কিংবা দায়িত্বের কথা চলে আসে। ব্যক্তির নিষ্ক্রিয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এর সুযোগ নিচ্ছে অন্ধকারের মুখোশধারীরা। এরাই ভোগ করছে আজকের ডিজিটাল উন্নয়নের সমস্ত সুবিধা। মানুষের জীবনকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। সৃষ্টি করে ফেলেছে এক ভয়ের সংস্কৃতি।
‘সংস্কৃতির সংকট’ বা ‘সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ’কে রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। লাকী খান আর টিনা খানকে সংস্কৃতি জগতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুর্ণবাসিত করে আমাদের গ্রামীণ লোকায়ত সংস্কৃতির সর্বনাশের শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছিলেন। আজ হারিয়ে গেল আমাদের লালন–হাছন। হারিয়ে গেল গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া, ঘেটু, যাত্রা। হাজার বছরের বছরের লোকসংস্কৃতি বলতে কিছুই আর থাকল না। পুরুষাক্রমের নাড়ির বন্ধন কখন যে ছিঁড়ে গেল কেউ টেরও পেলাম না। সবকিছু এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।
সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে না। সংস্কৃতির নামে বাণিজ্য হচ্ছে। ফলে প্রজন্মের মানস গঠনের কাজটা হচ্ছে না। এ কঠিন কাজ। এমনকী রাজনৈতিক দলও করছে না। এ কাজ সাংস্কৃতিক সংগঠন করছে না। এখন আর দেশে সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে কি? এখন আছে ব্যক্তি বিশেষের দল। তাও আবার শহরে। গ্রামে কোনো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। আছে ধর্মীয় কার্যক্রম। নাসিরউদ্দীন বাচ্চুকে টেলিভিশনে একাধিকবার আক্ষেপ করতে শুনেছি, যাত্রা, লোক নাট্য উৎসব করতে গেলে অনেকস্থান থেকে অনুমতি নিতে হয়। বেশির ভাগ সময় পাওয়া যায় না। ধর্মীয় গোঁড়ামি সবাইকে অন্ধ বানিয়ে ফেলেছে। এখন সবকিছু বিচার হয় ধর্মীয় নিক্তিতে। সে নিক্তির নাম ‘অনুভূতি’। এ ‘অনুভূতি’ ‘ঠুনকো’ নাকি ‘প্রবল’ বলব কি না জানি না। শুধুই আহত হচ্ছে।
আমরা উন্নয়নে সামনে এগুচ্ছি। কিন্তু মানস গঠনে অন্ধকার যুগের দিকে চলছি। এখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একুশের প্রভাত ফেরী দেখি না। সকালে শপথ আর জাতীয় সংগীত হয় না। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হলেও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা নেই। সংগীত শিক্ষার স্কুলগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। গান শিখিয়ে কতজনকে সংসার চালাতে দেখেছি। এখন সব রূপকথার গল্প। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বই কেনার কথা শুনি। ভালো উদ্যোগ। কিন্তু মন ভেঙে যায়, সে সঙ্গে যখন শুনি বই কেনা নিয়ে নানান রকমের দুর্নীতির কাহিনি। বই তো গেল। বাণিজ্যও হলো। কিন্তু এসব বই পড়ছে কিনা তার খবর কে রাখে। আমাদের এখানে খবর নেওয়ার মানুষও তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। তা না হলে গত তের বছরে পাঁচ জন ভিসিকে কেন আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হলো? এর মধ্যে তিন জন করেছেন দুর্নীতির অভিযোগে। কী ভয়ঙ্কর খবর!
ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে ১৯৭১ সালে এদেশ স্বাধীন হলেও এর চর্চা তেমনভাবে হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দেশও সাম্প্রদায়িকতার অতল গহবরে হারিয়ে যায়। এর সূত্রপাত করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানে মাথায় ধর্মের বাণী সংযোজন করে। এরপর তাঁরই উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন। তাই আজ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, কারণে কারণে সাম্প্রদায়িকতা নামের বিষধর সাপের ছোবল।
বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে এদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে চাষাবাদ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়, তা এখনও সরকারি না হলেও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অব্যাহত রয়েছে। ফলে তা যেকোনো ইস্যুতে জেগে ওঠে। এরমধ্যে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি লালন, হাসনের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে। সত্যি তখন পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফালগুন, মা দিবস, ভালোবাসা দিবস, এমনকী স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি আয়োজনকে হাস্যকর ঠেকে। কারণ এসব আয়োজন আমাদের দেশ থেকে বিগত ৫০ বছরেও সেই আকাট মুর্খতাকে বিনাশ করতে পারেনি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যদিওবা যতীন সরকার বলেছেন, ‘লোকসংস্কৃতি হলো আমাদের শেকড়। লোকসংস্কৃতিই পারে মৌলবাদ–জঙ্গিবাদ ও সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।’ আসলে এদেশে আকাট মুর্খ তৈরির অনেক কারখানা আর কারিগর থাকলেও মানুষ তৈরির কারখানা আর কুশিলবের বড়ই অভাব। মুক্তিযুদ্ধের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের জন্য যে স্কুলিং এর প্রয়োজন তা এখন আর নেই।
আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সেই ধর্মনিরপেক্ষার চেতনার কোনো প্রভাব পড়েনি। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে, মাদ্রাসার শিক্ষকের নামে ধর্ষণের অভিযোগ আসে, সেদেশে আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন অসম্ভব। সেখানে কেমন করে দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশে এখনও একমুখী শিক্ষা চালু করা যায়নি। নাগরিকের মধ্যে দেশপ্রেম না থাকলে, সৃজনশীল চেতনাবোধ জাগ্রত করতে না পারলে বারে বারে প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে। এদেশের মানুষের মধ্যে জাতিগতভাবে দেশপ্রেম বিকশিত হয়নি, যতটুকু সাম্প্রদায়িকতা বিকশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন লিখেছিলেন, ‘হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ, বাঙালি করে মানুষ করনি।’ আজকে যদি লিখতেন তবে নিশ্চয় ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না সন্দেহ হয়। আমাদের দেশে বিগত ৫০ বছরে মানস গঠনের কাজটি একবারের জন্যই হয়নি। মানস গঠনে দরকার প্রয়োজনীয় আলো–হাওয়া–সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং পারিবারিকভাবে। নজরুলের ভাষায় বার বার বলতে হবে– ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই। নহে কিছু মহীয়ান।/নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে, তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির–কাবা নাই।’ উপলব্ধিতে এমনতর অনুভূতি জাগাতে হবেই, জাগানোর পথ সুগম করতে হবে। অন্যতায় আগামীর পথচলা আরও ভয়াবহ হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার