দেশ হতে দেশান্তরে

পঞ্চইন্দ্রিয় ষষ্ঠইন্দ্রিয়

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৭ মে, ২০২৩ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আমি তো বলেছিই টাইগার বামের গন্ধ সহ্য হয় না আমার। না লাগবে না ওটা কিনতে। আর খুব ব্যাথাও নাই। যেরকম ব্যাথা আছে ওটা তো বহুদিন থাকতে থাকতে সহ্য হয়ে গেছে। এখন গাড়িতে ওঠে বসলেই হবে। চলো এগোই।” এ জগতে বিবাহিত দম্পতিদের ক্ষেত্রে যে কোন ব্যাপারেই স্ত্রীর বাক্যই শেষ বাক্য, সে কথা মনে করে কথা আর বাড়ালাম না। যদিও সে যখন আজই আগে একবার বলেছিল এবং তারও আরো আগে থেকেই জানি আমি টাইগার বামের গন্ধ বিষয়ে ওর তুমুল আপত্তি আর অস্বস্তির কথা, তারপরও আমাকে তো আর ভূতে কিলায় নাই যে এখানে এসে আবার আমি ঐ টাইগার বাম কিনবো! বরং অবশ্যই অন্য ব্যাথা নাশক বামই খুঁজতে চাইছিলাম আমি। মনের ভেতরের এই যৌক্তিক খচখচানিটি এরই মধ্যে বারবার খচ খচ করে আমাকে তো বলতে প্ররোচিত করলেও, মোটেও কান দিলাম না সেই মনের সেই কানকথায়।

এদিকে যেহেতু সামনে এগিয়ে থাকা পুত্রদের গতিবিধির দিকে চোখ রেখে এগুচ্ছিলাম, তাই দেখতে পেলাম পার্কিংলটে পার্ক করে রাখা আরো বেশ কটা গাড়ির কোন এক ফাঁক থেকে, ইতিমধ্যে উদয় হয়েছে লি খাঁ মানে আমাদের গাইড কাম শোফার। দ্রুতই সে এগুচ্ছে ওদের দিকে ।

বাহ, বেশ ভালো তো দেখছি লি খাঁর কর্তব্যবোধ! আমাদের অনুপস্থিতিতেও সে চলে যায়নি কোথাও, অন্য কোন ড্রাইভার বা তার কোন দেশী ভাইয়ের সাথে গুলগাপ্পি মারতে বা তাস পাশা খেলতে। থেকেছে সে গাড়ীর আশেপাশেই, আর চোখ রেখেছে গেটের দিকে, যাতে আমার বেরিয়ে এসে তাকে ফোন করে খোঁজার আগে নিজেই হতে পারে হাজির সশরীরে। নাহ , কুনমিং এর বন্ড মিয়া, আর বেইজিংএ লি খাঁর সাথে যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে বোঝা গেল আর যাই হউক তাদের সওয়ারির ব্যাপারে নিষ্ঠার অভাব নাই। এ বড়ই ভাল ব্যাপার।

হউক তা যতই তুচ্ছ কাজ, কেউ যখন তার কাজকে এরকম নিষ্ঠার সাথে তা পালন করে, তবে তার সফলতা নিশ্চিত। আর চায়নার এ ধরনের ড্রাইভারদের বেশীরভাগই যদি এরকম হয়, তবে আজকের দুনিয়ার আর সব নানান ব্যবসায় যেমন তারা রাজত্ব বিস্তার করেছে, তেমনি এই পর্যটন ব্যবসায়ও তারা করবে রাজ অচিরেই। একদিকে পর্যটক টানার মতো অসংখ্য প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, এমনকি আধুনিক উপাদানের যেমন কমতি নাই বিশাল বিস্তীর্ণ এই ভূমিতে; তেমনি আছে এদের পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা, নানান জাতের হোটেল, পাব শুড়িখানা। তবে পর্যটনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ নারিসঙ্গের ব্যাপারে আমার কোন অভিজ্ঞতা থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। আর নিরাপত্তার ব্যাপারে চায়নার সুনাম থাকাতেই পারিবারিক ভ্রমণের জন্য এটিই হয়েছিল আমাদের গন্তব্য। তার উপর যদি থাকে এরকম ড্রাইভার কাম গাইডেরা এখানে তবে আর এদের ঠেকায় কে?

তবে সমস্যা যে কিছুই নাই, তা তো নয়। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় বড় নোট মানে এমনকি পঞ্চাশ রেন মেন বি দিয়ে কেনাকাটা করতে গিয়ে, সে নোটের বিশুদ্ধতা পরখনিমিত্তে প্রতিটি নোটকে যেরকম ডলাডলির মুখোমুখি হতে দেখেছি, প্রতিবার প্রতিক্ষেত্রেই, তাতে আবারো হলো পরিষ্কার যে এখানে ভালই আছে জাল নোটের কারবার । আবার তিয়েন আন মেন স্কয়ারে পথ হারিয়ে মিস ইনা কে ফোন করার পর, সে যেরকম উদ্বিগ্নস্বরে জানতে চেয়েছিল যে কোন টাউট বাটপারের পাল্লায় পড়েছি কি না, তাতে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, যতোই নিরাপদ হউক এই দেশ এখানেও আছেন টাউটেরা মহাসমারোহে। সবশেষে কেনা কাটা করতে গিয়ে মেইড ইন চায়না মালের উপর ঘোর সন্দেহ তো আছে এমনকি আমাদের ছোট্ট অভ্ররও। “এই এই খবরদার কুকুরের গায়ে কেউ হাত দেবে না। এই ঠাণ্ডায় এখানে তোমাদের হাত ধোয়াতে পারবো না আমি”

পুত্রদের প্রতি এইমাত্র জারী হওয়া লাজুর এই সতর্কবার্তায় নজরে এলো , কোত্থেক কেমন করে যেন সকালে দেখা হয়ায় সেই কুকুর দুটিও উদয় হয়েছে। লেজ নাড়তে নাড়তে, দৌড়ে আসছে বড় মিয়া আর ছোট মিয়া, মানে বড় সাইজের আর ছোট পুডুল সাইজের দুই মালিকানাহীন সারমেয়। তবে কি এরা পুত্রদের ডাকেই এসে হাজির হল এখন? নাকি ওরাও লি খাঁর মতোই ওত পেতে বসেছিল কোথাও আমাদের ফেরার অপেক্ষায়, বুঝতে পারলাম না তা। কারণ চোখের সামনে এর আগের ঘটনাগুলো ঘটলেও, মগজে তা ঢোকে নি। যেহেতু সেসময় মগজ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল চায়নার পর্যটন ব্যাবসার সম্ভাবনা ও শংকা বিষয়ক হিসাবনিকাশে।

মহাআনন্দে কুই কুই করতে করতে লেজ নাড়তে নাড়তে ইতোমধ্যেই দেখছি দুই সারমেয় মিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, বার্গার কিং থেকে নিজেদের খাবার থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসা দু পুত্র আর হেলেনের দেয়া খাবার খাওয়া নিয়ে। স্বস্তি পেলাম দেখে যে, মাতৃআজ্ঞা মেনে দু পুত্রই কুকুরে গায়ে হাত দেবার মতলব করছে না। সাথে করে আনা খাবার ওরা, কুকুরদুটো একদম গায়ের কাছে এসে দাঁড়ানোর আগেই, টানা কংক্রিট ঢালাই করা পার্কিংলটের মেঝেতে ফেলে দিয়েছে আগেই। তাতে মহাউৎসাহে যেরকমভাবে ঐ খাবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে খাচ্ছে ওরা যেমন আনন্দে, তাতে মনে হচ্ছে অন্য কোন খাবার, মানে কোন চায়নিজ খাবার নয় তারা বুঝি আজন্ম এই আম্রিকান খাবারই খেয়েই গায়ে গতরে বড় হয়েছে। এছাড়া খাবার নিয়ে নিজেদের মধ্যে যাকে বলে কুত্তা মারামারি বা খেয়োখেয়ি তাও নাই। পর্যটন এলাকায় থাকার কারণেই সম্ভবত এরা আম্রিকান খাবারে এমন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। খুব বেশি খাবার তো আনেনি ওরা। দ্রুতই তাই দুই জাতের এই দুই সারমেয় তা খেয়ে শেষ করে, লেজ নেড়ে নেড়ে কুই কুই শব্দ করার সাথে মাথা আর কান নানান ভঙ্গিতে নেড়ে নেড়ে, অপার কৃতজ্ঞতায় পুত্রদের গায়ের সাথে সম্ভবত গা ঘষাঘষি করার আশায় এগুতেই ফের লাজুর সতর্কবার্তা ঘোষিত হতেই , দু পুত্র ইংরেজিতে ওদের উদ্দ্যেশে “ওকে ওকে, স্টপ স্টপ, নো নো, গো গো” বলতেই দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো নিরাপদ দূরত্বে।

আচ্ছা কুকুর দুটি কি আম্রিকান ভাষাও রপ্ত করে ফেলল নাকি? কিন্তু না, তা হবে কিভাবে? এখানে তো চায়নিজ পর্যটকই তুমুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই আম্রিকান খাবারের প্রধান ভোক্তাও চায়নিজরাই। আর এদের আমেরিকান খাবারের উৎসও হল প্রধানত চায়নিজ পর্যটকরাই। তা হলে এরা ইংরেজি বুঝলো কিভাবে? আবার পুত্ররাই বা কেন ইংরেজিতে বাৎচিত করলো? তারা কি মনে করেছে যে চায়নিজ কুত্তা বাংলা বুঝবে না? সেজন্যই কি তারা ইংরেজি বলল?

আচ্ছা এ তো দেখছি এক মজার ব্যাপার, যে মনে হল এইমাত্র। আর তা হল, আর অন্যসব প্রাণী না হলেও সারা পৃথিবীতেই তো কুকুরেরা আছে মনে হয় মানুষের সঙ্গী হয়ে । হয় পোষা হিসাবে না হয় নেড়ি হিসাবে। কথা হচ্ছে দেশে দেশে মানুষের ভাষা নানান রকম হলেও সারা পৃথিবীতে কুকুররা তো একই ভাষায় কথা বলে নিজেদের মধ্যে। মানুষ কেন তাহলে এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়লো নানান ভাষায়? এটা কি তবে তার সেই মস্তিষ্কের ক্ষমতার কারনেই হল, হয়নি যা অন্য প্রানিদের মধ্যে?

কি ব্যাপার তোমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? একে তো এখন বেশ ঠাণ্ডা বেড়েছে, তার উপর আমি তো বললাম যে গাড়িতে উঠে আমি রেস্ট নেব।”

স্ত্রীর এই কথায় মনের ভেতরকার সারমেয়বিষয়ক গবেষণায় দ্রুত যতি টেনে, সবাইকে গাড়িতে ফেরার তাড়া দিতেই অনতিদূরে পার্ক করে রাখা গাড়ির দিকে রওয়ানা করলো সবে একযোগে। এদিকে হাল ছাড়েনি ওরাও। দেখছি কৃতজ্ঞতায় যাকে বলে মাথা নুইয়ে কুই কুই করতে করতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আসছে সারমেয়রাও পিছু পিছু। আসলে আমরা মানুষেরা যতই নিজেদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে বড়াই করি না কেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে এদের কাছে তো দেখছি আমরা কিছুই না ।

সে যাক, এরই মধ্যে সবাই গাড়িতে উঠে বসে পড়তেই নিজ আসনে লি আসীন হয়ে, কোনদিকেই না তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এঙেলেটরে হালকা চাপ দিতেই গাড়ি সামনের দিকে এগুতেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে শুধু বললাম– “সামার প্যালেস।” মানে তাকে জানালাম যে এখন আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হবে ঐ সামার প্যালেস

কেমন যেন একটু থমকে গেল এতে, লি খাঁ । টের পেলাম তা অতি সামান্য সময়ের জন্য গাড়িটিও থমকে যাওয়াতেই। কিছুটা দ্বিধার ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে, অতি সামান্য সময় চিন্তা করেই লি খাঁ “ওকে” বলতেই বুঝলাম যে, ওর থমকে যাওয়াতে আমি যে প্রথম ভেবেছিলাম হয়তো আমার বাংলিশ উচ্চারনের সামার প্যালেস তার চিংলিশ কানে বুঝি ঠিকমতো ঢোকেনি, তা নয়। অন্তত এ মুহূর্তে বাংলিশ চিংলিশ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু ঐ যে দ্বিধার ভাবটুকু দেখলাম লি খাঁর, তার মাজেজা কি?

এ ভাবনার মধ্যেই গাড়ি পার্কিংলট থেকে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেশ দ্রুতই চলে এসেছে মনে হল মূল রাস্তায়। যদিও জানি, কিছুই চিনবো না তারপরও কেন জানি বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম যাচ্ছি কোনদিকে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। এ কি শুধু আমারই হয়, নাকি সবারই হয়।

দু পাশে এরই মধ্যে গতি বেড়ে যাওয়া হিম বাতাসের তোড়ে রাস্তার দুপাশে পায়ের কাছে গতরাতের বা তারও আগে জমে থাকা সাদা সাদা জমাট বরফ নিয়ে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা নানান আকারে সবুজ গাছগুলোর পাতা আর ডালপালা তুমুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও আড়মোড়া ভাঙ্গতে বাধ্য হচ্ছে। এদের দেখে কেন জানি মনে হল, যে রাস্তায় এসে ঢুকেছিলাম এই মুতিয়ানু মহাপ্রাচীরের টিকিটঘর এলকায় এ রাস্তা সে রাস্তা নয়। তবে কি এমন মনে হওয়ার কারণ হল আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে যে ষষ্ঠইন্দ্রিয় আছে তারই ইশারায়?

কিন্তু সেটাই বা হবে কিভাবে? যতোটা জানি, আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ধরা ছোঁয়ার বাইরে হলেও, যেসব বিষয় কখনোই পঞ্চইন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয়নি, মানে যে সব নিয়ে আমাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই কিম্বা যে সব বিষয়ে আমাদের কোন জ্ঞান নাই, ঐ রকম বিষয়ে কোন ধরনের সঙ্কেত দিতে পারে না। লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেকড়ের সন্ধানে
পরবর্তী নিবন্ধসংকটটা হাল আমলের নয়