শোর-লিভ এবং সাইন-অফ

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:০০ পূর্বাহ্ণ

আজকের এই লেখাটি একজন পাঠিকার অনুরোধে
লেখা হলো
জাহাজে নাবিকদের দুইটা সময় খুবই আনন্দের- ঝযড়ৎব-ষবধাব এবং ংরমহ-ড়ভভ; এমনই আনন্দের যে অনেককে বলতে শুনেছি ‘ঈদুল-সাইন অফ’। জাহাজের একঘেঁয়ে জীবনে, সমুদ্রের মাঝে পার্টিগুলো আনন্দের, বার্বিকিউ-পার্টি হলে আরো মজা। আগেকার যুগে পোর্টে পৌঁছালে বাসা থেকে চিঠি পাওয়াটা আনন্দের, পোর্টে গিয়ে দেশে ফোনে কথা বলতে পারাটা আনন্দের। এখন অবশ্য ইন্টারনেটের যুগে, চিঠির চল তো উঠেই গেছে; আর ফোনও মনে হয় না কেউ বাইরে গিয়ে করে। সবই তো এখন ডযধঃংঅঢ়ঢ়, ঠরনবৎ , গবংংবহমবৎ-এ চলে।
যাইহোক শোর-লিভের কথায় আসি। জাহাজে কাজ করার একটা বড় আকর্ষণই হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখার সুযোগ পাওয়া। আগেকার সময়ে পোর্টে কার্গো লোডিং-ডিসচার্জিং করতে অনেক সময় লাগতো। বিশেষ করে কিছু কিছু পোর্টে তো দিনের পর দিন লেগে যেত; মাঝে মাঝে সপ্তাহ বা মাসকাবার। এতে আমাদের সুবিধা ছিলো, ধীরে-সুস্থে জাহাজের কাজ করতাম আর পোর্টে ঘুরে বেড়াতাম। আস্তে আস্তে টেকনোলোজির উন্নতি হতে লাগলো, পোর্টগুলোতে ভালো ক্রেইন, গ্যান্ট্রি ইত্যাদি লাগালো। কন্টেইনার জাহাজ বেড়ে গেলো, সেগুলো অনেক দ্রুত লোডিং-আনলোডিং করে। সব মিলিয়ে পোর্টে থাকার সময় গেলো কমে।
ড্রাই বাল্ক-ক্যারিয়ার জাহাজগুলোতে চাল-ডাল-গম-কয়লা-সিমেন্ট বা এই ধরনের মালামাল নেওয়া হয়, যেগুলো জাহাজের খোল বা হোল্ডের ভিতরে বিপুল পরিমাণে (নঁষশ) বোঝাই করা যায়। ক্রেইনে এক লোড করে করে বোঝাই করতে অনেক সময় লাগতো। একইভাবে জেনারেল কার্গো শিপে নানান ধরনের মালপত্র নেওয়া হয়- মেশিন, ফার্নিচার, বাক্স-প্যাটরা ইত্যাদি সবকিছুই। সেগুলো লোড-আনলোড করতেও প্রচুর সময় যেত। কিন্তু কন্টেইনার শুরু হওয়ার পরে, লোডিং-আনলোডিং-এর সময় একদমই কমে গেলো। সেই তিরিশ বছর আগেই জাপানে দেখেছিলাম, তারা জাহাজ পোর্টে আসার আগেই সব রেডি থাকতো। কোনটা নামাবে, কোনটা তুলবে। জাহাজ বাঁধার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যেত কাজ; এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিদায় করে দিতো – দক্ষতার চরম উদাহরণ। সময়ের বিন্দুমাত্র অপচয় করতে দিতো না। তেলের বা কেমিক্যালের ট্যাঙ্কারগুলো হলো স্পেশাল জাহাজ। তাদের জন্য আলাদা বার্থ, এবং পাম্প করে জাহাজে ভর্তি করে, ডিসচার্জিং-এর সময়ে জাহাজ থেকে পাম্প করে বের করে দেয়। ট্যাঙ্কের ধারণ ক্ষমতা ও পাম্পের ক্যাপাসিটির উপরে সবকিছু নির্ভর করে। আরো স্পেশাল জাহাজ আছে- রো/রো (জড়ষষ-ঙহ/জড়ষষ-ঙভভ) বা কার-ক্যারিয়ার, রিফার বা রেফ্রিজেরাটেড জাহাজ, ক্যাটল্‌-ক্যারিয়ার (জীবিত পশু বহন করে- গরু-ছাগল-ভেড়া-শুকর)। কার্গোর উপরে ভিত্তি করে একেক জাহাজে একেক রকমের সময় লাগে।
যা হোক, আমাদের শোর-লিভর কথায় আসি। অনেকদিন জাহাজে পানির মধ্যে বন্দি থেকে, পোর্টে আসলে সবারই ইচ্ছা হয় একটু ঘুরে বেড়াবার। সেজন্যে পোর্ট থেকে আমাদের স্পেশাল পারমিশান দেওয়া হতো যার নাম শোর-পাস কয়েক ঘন্টার জন্য সে দেশে ঘুরে বেড়ানোর ভিসা। কিছু কিছু দেশ কখনই শোর-লিভের জন্য শোর-পাস দিতো না সৌদি আরব, কুয়েত। আবার কিছু কিছু দেশে অনেক কড়াকড়ি থাকে, বিশেষ করে ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে অ্যামেরিকা। কিছু দেশ থাকে একদমই শিথিল। জাহাজে আমরা আগের থেকেই মোটামুটি জেনে যাই কোন্‌ পোর্টে যাবো, মাল খালাস বা বোঝাই হবে কি হবে না ইত্যাদি। আর আমাদের মধ্যে যারা আগে সেই পোর্টে ঘুরেছে, তাদের থেকে সকলে জেনে নেয় কি কি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাওয়া যায়, কীভাবে যেতে হবে, কোথায় ডলার ভাঙ্গাবো, ট্যাক্সি কোথায় পাবো, ইত্যাদি সব ইনফরমেশান।
শোর-লিভে গিয়ে সেখানের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার চেষ্টা করতাম মিশরের পিরামিড, প্যারিস শহর, আইফেল টাওয়ার, লন্ডন শহর, বিগ-বেন, বাকিংহ্যাম প্যালেস, সিঙ্গাপুরে শপিং, ফ্লোরিডাতে ডিজনি, লস-এঞ্জেলেসে হলিউড এইরকম বিশ্বের সব নামকরা এট্রাকশানগুলো। সুযোগ-সুবিধা এবং দাম বুঝে শপিং-ও করতাম। জাহাজে বেতন পেতাম, কিন্তু খরচ করার জায়গা ছিলো না জাহাজে আমাদের থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। আর স্বাভাবিকভাবেই, বিদেশ গেলে আত্মীয়-স্বজনের জন্যে কিছু গিফ্‌ট্‌-খেলনা-চকলেট কিনতে ইচ্ছা করে। জাহাজের কুকের রান্নার একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য শোর-লিভের সময়ে বাইরে রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিতাম- বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের খাওয়ার টেস্ট করতাম। শোর-লিভের খারাপ দিক হলো, অনেক বেশী ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে, জাহাজের ডিউটিতে অসুবিধা হয়। আরেকটা জিনিস প্রায়শই হয়- ঠকে, বোকা বনে আসা। মেরিনাররা প্রতি পোর্টেই নতুন আগন্তুক। অনেকেই তাদের ঠকিয়ে পয়সা হাসিল করে নেয়- ট্যাক্সি-ড্রাইভার, দোকানদার বা অন্য অনেকেই। লোকাল ইনফরমেশান না জানা থাকলে, ঠকতেই হয়।
কোনো কোনো পোর্টে সেইলর্স-ক্লাব থাকতো। সেগুলো কোনোটা চালাতো পোর্ট-অথরিটি, কোনোটা হয়তোবা কোন চার্চ, বা কোন সামাজিক সংগঠন, বা প্রাক্তন নাবিকেরা। সেখানে রিল্যাক্স পরিবেশে, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা, খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকতো। বই-ম্যাগাজিন-টিভি-ভিডিও ছিলো। কতগুলোতে, দেশে ফোন করার ব্যবস্থাও থাকতো।
সেইসময়ে গভীর-সমুদ্রে থাকা অবস্থায় দেশে ফোন করা মানে পকেট ফাঁকা হয়ে যাওয়া। মোবাইল বা ইন্টারনেট বলে কিছু ছিল না। স্যাটেলাইট-রেডিওর মাধ্যমে প্রচুর ডলার খরচ করতে হতো। নিজের প্রথম বিবাহ-বার্ষিকীতে ব্যাপারটা শিখেছিলাম, এরপরে ইমার্জেন্সি নাহলে চিন্তাই করতাম না। সেজন্যে শোর-লিভে গিয়ে চেষ্টা করতাম দেশে ফোন করতে। কোনো কোনো দেশে রাস্তার পাবলিক ফোন বুথ থেকে কার্ড দিয়ে করা যেতো, কোথায়ও যেতাম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসে। জাহাজে বিভিন্ন দেশের নাবিকদের সঙ্গে কাজ করতাম। ফোন করতে গিয়ে খুব কষ্ট হতো। সব্বাই যে-যার নিজের দেশে সুন্দর ফোন করে কথা বলে ফেলছে; বাংলাদেশে লাইন পেতে কি যে ঝামেলা। অনেকবার ঘুরিয়ে হয়তো একটু লাইন পেলাম, তা-ও বা ঘ্যাঁসঘ্যাঁসে শব্দ। কিছু শুনতে পারি, কিছু পারি না; লাইন কেটে যায় বারবার। আর বাংলাদেশে কল করার রেইটও অন্যান্য সব দেশ থেকেই বেশী। অনেকবারই কথা বলতে না পেরে মনে দুঃখ নিয়ে জাহাজে ফিরেছি।
এবারে সাইন-অফ নিয়ে বলি। জাহাজে জয়েন করাটাকে বলে সাইন-অন; আর বুঝতেই পারছেন সাইন-অফ মানে কাজ শেষে বাসায় ফিরে যাওয়া। সেজন্য ‘ঈদুল-সাইন-অফ’ বলাটা খুব বেশী বাড়িয়ে বলা নয়। অতি প্রাচীনযুগে জাহাজে জয়েন করলেই যে দেশে ফিরে যেতে পারবেন, তেমন কোন গ্যারান্টিই ছিলো না। বর্তমানে অবস্থার উন্নতি হয়েছে, নতুন টেকনোলোজি, নতুন ও নিরাপদ জাহাজ, ইত্যাদি সব। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে আমি যখন জাহাজে কাজ করতাম, তখন কন্ট্রাক্ট থাকতো একবছর বা দশমাস, ছয়মাস ভিত্তিতে। এখন শুনি চারমাসের কন্ট্রাক্ট। জাহাজে জয়েন করেই সবাই ক্যালেন্ডারে দিন ক্রস করা শুরু করে কন্ট্র্যাক্ট শেষ হতে আর কয়দিন বাকি? সম্প্রতি একটা টার্ম দেখলাম “আর মাত্র পাঁচটা বিরিয়ানী বাকি”। আমাদের উপমহাদেশের মশলাদার খাওয়ার সুনাম সবসময়ই। বিরিয়ানী এখন সারাবিশ্বেরই হিট আইটেম। জাহাজে প্রচুর ইন্ডিয়ান-পাকিস্তানী-বাংলাদেশী মেরিনার কাজ করে। আমাদের উপমহাদেশের কুকরা বিরিয়ানী খাইয়ে খাইয়ে এটাকে প্রসিদ্ধ করে ফেলেছে। এমনই হয়েছে যে, এখন অনেক জাহাজেই রবিবারের লাঞ্চ ফিক্সড্‌ – বিরিয়ানী। ‘পাঁচ-বিরিয়ানী বাকি’ মানে হলো পাঁচ সপ্তাহ বাকি। সাইন-অফের সময় ঘনিয়ে আসলে সব্বাইকে তাগাদা দেওয়া শুরু করে, কবে কোথায়, কোন পোর্ট থেকে কীভাবে আমাকে দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। বিশ্বাস করুন- সাইন-অফ করে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুভূতি লিখার মত কোন ভাষা এখনো বের হয় নাই।
দুঃখজনকভাবে গত দুইবছরে করোনার কারণে জাহাজের নাবিকদের বিশ্বের কোনো দেশেই শোর-লিভ দেয়নাই। বেচারারা সারাদিন সারারাত জাহাজেই কাটিয়েছে। অনেক দেশই তাদেরকে সাইন-অফ করে দেশে ফেরৎ যাওয়ার ব্যবস্থাও করতে দেয় নাই। অনেক নাবিকই এক-দেড় বছরেরও বেশী সময় ধরে একই জাহাজে আছে তো আছেই। একদম আটকা পড়ে গিয়েছিলো। এখন ভ্যাক্সিন আসার পরে কয়েকটা দেশ কিছুটা নমনীয় হলেও, অনেক দেশ এখনও আগের মতই। বিশ্বের ৭০%-৯০% মালামাল বহনকারী জাহাজগুলোতে যে নাবিকরা কাজ করছে তাদের কথা কেউই চিন্তা করে না।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেষ চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধশিল্পকলায় আবৃত্তি বিষয়ক কর্মশালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান