শিশু রাসেলের প্রতি বাবার ভালোবাসা

পিংকু দাশ | মঙ্গলবার , ১ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬-১৯৬৯ পর্যন্ত কারাগারে বন্দি ছিলেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লেখাগুলি সযত্নে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। জেলখানার ভিতরে হাজারো কয়েদিদের জীবনযাপন, কোন অপরাধে তারা জেলে এসেছে, দেশের পরিস্থিতি, দেশের বিভিন্ন আন্দোলন, নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনযাপনের সাথে শিশুপুত্র রাসেলকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁর অনুভূতিগুলো সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। কারাগারে অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতেন বঙ্গবন্ধু। তখন কারাগারের বিভিন্ন ঘটনা দুর্ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সরবরাহকৃত খাতায় তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। যা ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎস হিসেবে জাতির কাছে সংরক্ষিত থাকবে আজীবন। বঙ্গবন্ধু এই লেখার একটি নামও দিয়েছিলেন। ‘থালাবাটি কম্বল/জেলখানার সম্বল’।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঐতিহাসিক ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এর ঘর আলো করে জন্ম নিল ফুটফুটে এক শিশু। বঙ্গবন্ধু পরিবারের আদরের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। জন্মের সময় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অশান্ত, অস্থির। এরকম একটা সময়, যখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনৈতিক মিটিং এ চট্টগ্রামে। সাহিত্যপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্টান্ড রাসেল। তাঁর নামের সাথে মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রিয় পুত্রের নাম রাখেন রাসেল। পুরো নাম শেখ রাসেল।
শৈশব থেকেই শিশু রাসেল দেখে আসছেন তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু প্রায় সময় কারাগারেই থাকেন। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আর এগারো দফা ঘোষণার পর থেকেই পিতা বঙ্গবন্ধু কারাগারে। তখন রাসেলের বয়স দুই বছরের চেয়েও কম। তাই সে মনে করত কারাগারই আব্বার বাড়ি। ‘কারাগারের রোজনামচায়’ ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না। যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে আব্বার বাড়ি। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়’।
প্রতি ১৫ দিন পর পরিবারের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন বঙ্গবন্ধু। ছেলেমেয়েরা বেগম মুজিবের সাথে আসতেন জেলগেটে আব্বার সাথে দেখা করতে। ছোট ছেলে রাসেলকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট অনুভব করতেন বঙ্গবন্ধু। তাই অপেক্ষা করে থাকতেন কখন দেখবেন আদরের ছেলে রাসেল এবং পরিবারের অন্যান্যদেরকে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ চব্বিশ নম্বর পাতায় শিশু রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ওতো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো’। ও কি বুঝতে চায় ! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা,ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!
দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমিতো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে’’।
অনেকটা চাপা স্বভাবের রাসেল মুখে বোল ফোটেনি, কিন্তু বাবার স্নেহ বোঝে তাই সে সবসময়ই বাবাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চান। এ কারণে তাঁর মন সবসময় খারাপ থাকতো। বাবা বঙ্গবন্ধুও তাকে ভীষণ মিস করতেন। শিশু সন্তানকে কী উত্তর দিবেন, এটা ভেবে দুঃখ পেতেন।
আদরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নিয়ে পিতার সাথে কারাগারে সাক্ষাত করতে যাওয়া প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নিজের লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের একুশ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আব্বার সাথে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইতো না। খুবই কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হত। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হত তা আমরা বুঝতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বুঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে সেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকতো’।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ সালের ১৪-১৫ এপ্রিলে রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন, ‘জেলগেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে আব্বা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি ? ওর মা বলল, “বাড়িতে আব্বা আব্বা করে কাঁদে, তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে”। রাসেল আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা’। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না’।
মাতৃভূমি রক্ষার জন্য, দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জীবনে বহু ঈদ বঙ্গবন্ধু জেলে কাটিয়েছেন। সেরকম এক ঈদে শিশু সন্তান রাসেলকে ছেড়ে একাকিত্বের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ১লা জানুয়ারি -২০ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘১১ তারিখ রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নিবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন কর।
এই ঈদটা আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার আব্বা ও মায়ের কাছে বাড়িতেই করে থাকি। ছোট ভাই খুলনা থেকে এসেছিল আমাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। কারণ কারও কাছে শুনেছিল ঈদের পূর্বেই আমাকে ছেড়ে দিবে। ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি নাই। ওরা বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট্ট তাই এখনও বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভালো না। কিছুদিন ভুগেছে। দেখা করতে এলে রাসেল আমাকে মাঝেমাঝে ছাড়তে চায় না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়। আমিও বেশি আলাপ করতে পারলাম না। শুধু বললাম, ‘চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোন আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে’। ওদের কাছে থেকে বিদায় নেবার সময় রেণুকে বললাম, বাচ্চাকে সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে’’।
পিতার সান্নিধ্য থেকে রাসেল বঞ্চিত হয়েছে। কারণ সে এমন একজনের ছেলে, যাঁর পুরো জীবনটাই দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে ঘেরা। পিতা ছাড়াই রাসেল বড় হয়েছে মা, ভাইবোনদের ভালোবাসায়। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হল তখন রাসেল একটু একটু বুঝতে শিখেছে। ছলছল চোখে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরে আসেন, শিশু রাসেল এর আনন্দ যেন আর ধরে না। বাবাকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারতেন না। সব সময় উৎকণ্ঠায় থাকতেন, কখন আবার আব্বা ওকে ছেড়ে চলে যান।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ইতিহাসের বর্বরতম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের দিন। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও ঘটেনি। ওই দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মা ফজিলাতুন্নেসাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ঘাতকদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১১ বছরের শিশু রাসেল। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের ছেলে আবদুর রহমান শেখ ওরফে রমার জবানবন্দি থেকে জানা যায়, সেদিন উপর থেকে আব্দুর রহমান শেখ ও শেখ রাসেলকে আর্মিরা নিচে নিয়ে আসে। শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধুর পিএ মুহিতুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘ভাইয়া আমাকে(আর্মিরা) মারবে না তো’। শিশু রাসেলকে আর্মিরা মারবে না-সেই ধারণাতেই তিনি(মুহিতুল) বললেন, ‘না ভাইয়া তোমাকে মারবে না’। তারপর একজন আর্মি তাঁর(মুহিতুলের) নিকট থেকে রাসেলকে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। তখন রাসেল মায়ের কাছে যেতে চায়। রাসেলকে তাঁর মায়ের কাছে দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর শোনা যায় কয়েকটি গুলির শব্দ এবং আর্তচিৎকার।
বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনে লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিতে একজন শিশু এবং তার পিতার মনের আকুতি বিভিন্ন সময়ে ফুটে উঠেছে। শেখ রাসেলের আদর্শ, মানবিক গুণাবলি, মূল্যবোধ আবেগ ও ভালোবাসা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য মন্ত্রিসভা ১৮ অক্টোবর দিনটিকে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। শিশুদের অধিকার আদায়ের দিন ‘শেখ রাসেল দিবস’। মানবতার প্রতীক শেখ রাসেলের জীবনী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে আমাদের শিশু কিশোররা আলোকিত জীবন গড়ে তুলতে পারে। শেখ রাসেলের মানবতাবোধ, ছোট বয়সেই নেতৃত্বসুলভ আচরণ, পরোপকারী মনোভাবগুলো আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনুকরণীয় অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।
সূত্র : ১। কারাগারের রোজনামচা – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২। আমাদের ছোট রাসেল সোনা -মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ৩। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক -মোতাহার হোসেন সুফী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি),
বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোগ প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধগ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তৎপর হতে হবে