বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে গতকাল ১২ জুন। এবারের জাতীয় প্রতিপাদ্য ছিলো ‘মুজিব বর্ষের আহ্বান, শিশুশ্রমের অবসান’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও শিশুদের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
শিশুশ্রম নিরসনে আমাদের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এ নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেওয়া যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কাজে নেওয়া যাবে, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেওয়া যাবে না। আসলে শিশুদের জন্য সব কাজই ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও ৩৮টি কাজকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই ৩৮টি কাজে শিশুদের কোনোভাবেই নিয়োগ করা যাবে না। শিশুশ্রম নিরসনে জাতিসংঘ প্রণীত সব সনদে আমাদের সরকার অনুস্বাক্ষর করেছে। শিশুশ্রম নিরসনের জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নীতির প্রয়োগ, শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, সামাজিক সচেতনতা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের উন্নয়নে শিশুশ্রম একটি বড় বাধা। যত দ্রুত সম্ভব এ বাধা দূর করতে হবে। দেশকে শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা, ঘৃণা ও লজ্জা তৈরি করতে হবে। এতে শিশু শ্রম কিছুটা হলেও কমবে। এ কাজে সরকারের যেমন সদিচ্ছা আছে, তেমনি নাগরিকদের সহায়তা প্রয়োজন। শিশুশ্রম বন্ধে প্রয়োজনে ভাতা কার্যক্রম চালু করতে হবে। কেননা, দারিদ্র্য শিশুশ্রমের মূল কারণ। তারা লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম বেশি। যে বয়সে একটি শিশুর বই, খাতা, পেন্সিল নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া, আনন্দ চিত্তে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা, সেই বয়সে ঐ শিশুকে নেমে পড়তে হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে একজন পিতা যখন তার পরিবারের ভরণপোষণে ব্যর্থ হয়, তখন ঐ পিতার পক্ষে তার সন্তানদের পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ রাখা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এভাবে একটি শিশু একবার পারিবারিক বন্ধন হতে বিচ্ছিন্ন হবার পর সে হারিয়ে যায় অগণিত মানুষের ভিড়ে। মানুষের বাড়িতে, দোকানপাটে ফরমায়েস খাটা থেকে শুরু করে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও নিয়োজিত হচ্ছে। আর এই সুযোগে দেশের প্রচলিত আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে শহরের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম আছে, তা যেমন বাস্তবতা; তেমনি আনন্দের কথা হলো ধীরে ধীরে কমছে। এটাও বাস্তবতা। এসডিজিতে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনাকে জোরদার করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একটি লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি। একটা ভাগ থাকবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। আরেকটা ভাগ থাকবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। দুই পর্বেই আমাদের জোরেশোরে কাজ করতে হবে। কাজ করার জন্য নীতিমালা ও বিভাগীয় পর্যায় থেকে উপজেলা পর্যন্ত কমিটি রয়েছে। জেলা পর্যায়ে ডিসি থাকেন কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি ৭০টির বেশি কমিটির চেয়ারম্যান থাকেন। ফলে সময় দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে জেলায় কো-চেয়ারম্যান বা অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে কমিটিগুলোকে কার্যকর করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিক্ষাবঞ্চিত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শিশুদের স্বল্পমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণদানের পর তাদের ঝুঁকিমুক্ত কাজের সংস্থানের জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলে শিশুশ্রমের প্রবণতা কমে যাবে। অধিকারবঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসনের মানবিক দায়িত্ব সমাজের বিত্তবানদের ও রাষ্ট্রের। শিশুশ্রম বন্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে বাস্তবায়নের পথও উন্মুক্ত হবে। শিশুদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা ছাড়া শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না। এ লক্ষ্যে শিশুশ্রমের কুফল সম্বন্ধে শিশুর অভিভাবকসহ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তোলাসহ শিশুদের শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে।