শিশুদের জন্য মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান, নৈতিকতার কেন্দ্রস্থল ও শাশ্বত বিদ্যালয় হলো পরিবার। পরিবার যদি আনন্দময়, শিক্ষা উপযোগী ও শিশুবান্ধব পরিবেশ সম্পন্ন হয়, তবে শিশু সৃজন, মনন-মানসিকতায় ও রুচিবোধে উন্নত হবে, নিজের সৃষ্টি দেখে উল্লসিত হবে, নিজের জীবন গঠনে অনুপ্রাণিত হবে এবং নিজেকে বিশ্ব নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে শিশুরা আজ অনিরাপদ। এমনকি পরিবারেও নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিশুর নিরাপত্তায় মা- বাবার সচেতনতা বৃদ্ধি না ঘটা, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ না হওয়া ও যথেষ্ট মনোযোগী না হওয়া তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই পরিবারের সচেতনতা পারে শিশুর আনন্দমূলক শিক্ষার সূতিকাগার হতে। এজন্যই ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স বলেছেন, ‘বদান্যতা ঘর থেকে শুরু হয়।’ তাই শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে আগ্রাসী মনোভাব সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই পরিহার করতে হবে।
আনন্দমূলক ও শিশুবান্ধব পরিবেশে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের গুরুত্ব ও প্রভাব অনস্বীকার্য। সাহিত্যিক আবুল ফজল বলেছেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতির প্রাণশক্তি তৈরির কারখানা আর রাষ্ট্র ও সমাজ দেহের সব চাহিদার সরবরাহ কেন্দ্র। ওখানে ত্রুটি ঘটলে দুর্বল আর পঙ্গু না করে ছাড়বে না।’ খেলার মাঠ ও পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ, সহশিক্ষা কার্যক্রম, শিশুতোষ সাহিত্য ও লাইব্রেরি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুশোভিত মনোরম পরিবেশ অর্থাৎ পুরো বিদ্যালয়টি হতে হবে শিশুর জ্ঞানের সাম্রাজ্য। যেখানে পরিবারের মতোই শিশু ক্যাম্পাস থেকে নির্ভয়ে ও নিরাপদে আগ্রহী মন দিয়ে মেধার বিকাশ ঘটাবে ও আহরণ করবে জ্ঞান। শিশুর প্রতিভার বিকাশে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা তথা পুরস্কার সচেতনতা বৃদ্ধি, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা মোকাবেলায় সহায়তা ও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক নির্যাতনে সহায়তা ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আজকের শিশুরাই আগামীদিনের জাতির কর্ণধার। মেধার ও প্রতিভার বিকাশ সাধনে সামাজিক পরিবেশ দ্বারা শিশু মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে শিশু ভালো – মন্দ শিক্ষা লাভ করে থাকে। শিশুর বিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমাজের। চিত্ত বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ, ক্লাব, পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা, বৃত্তিমূলক কর্মসূচির ব্যবস্থা করা, শিশুর অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও বাসস্থানের সু-ব্যবস্থার ও সুনিশ্চিতকরণের দায়িত্ব সমাজের ও সরকারের। বিদ্যালয় থেকে শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে এবং শিশুশ্রম বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের মানুষদের মাধ্যমে রাষ্ট্রকেও।
নিষ্পাপ নিরপরাধ শিশুরা আজ নিরাপদ কোথায়? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু এর মতে ‘চলতি বছর দেশে একের পর এক যেভাবে শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, তা বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমেয়।’ সমাজ থেকে দ্রুত এই অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো অধিকতর জরুরি। শিশু নির্যাতন নিয়ে দরকার সমাজতত্ত্ববিদ, মনোবিজ্ঞানীসহ বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত গবেষণা এবং মানুষের অপরাধ প্রবণতার কারণগুলো উদ্ঘাটনপূর্বক প্রতিকার ব্যবস্থা করা। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যে দীক্ষা প্রয়োজন, তার ঘাটতির কারণেই শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও প্রতিভার বিকাশ সাধনে এবং সর্বোপরি মনুষ্যত্ব অর্জনে তা যেন প্রধান অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য সকল নাগরিকদের সচেতনতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে প্রচারণা বাড়াতে হবে। কারণ বিশ্বজুড়ে এখন চলছে সভ্যতার জয়গান। আর আমরাও সভ্যতা অর্জন করতে চাই শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মধ্য দিয়ে। আসুন, শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় পৃথিবী গড়ে তুলি এবং বিবেকবোধ জাগ্রত করি।